আটপাড়ায় শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে শিক্ষার ব্যাপক সাড়া

বিশেষ প্রতিনিধি: শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ থেকে ফসলের মাঠ। যে কচি হাতে বই, খাতা-কলম সেই হাতেই রোপন করছে ধানের চারা। ছেলে-মেয়ে সব শিক্ষার্থী মিলে শুধু ধান রোপনই নয়, শিখছে রান্না-বান্নাসহ সব কাজ। নতুন পাঠ্যসূচি বাস্তবায়ন করতেই নেত্রকোণার খিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক শুরু করেছেন হাতে-কলমে এই কার্যক্রম। শত শত শিক্ষার্থী জমি তৈরি থেকে শুরু করে কাদায় নেমে দিনভর করছেন ধানের চারা রোপন। তারা বলছেন, এই শিক্ষা তাদের বাস্তব জীবনে কাজে আসবে শতভাগ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রখর রোদে মাঠে ধানের চারা রোপনে ব্যস্ত স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শতাধিক শিক্ষার্থী। জেলার আটপাড়া উপজেলার খিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক শাকিল আহমেদ হাতে-কলমে শেখাচ্ছেন পাট্যসূচীর একটি অধ্যায়। ছেলে-মেয়ে সব শিক্ষার্থীরা সবাই কাজ করছেন মাঠে। ধান রোপনের এই দৃশ্য দেখতে আসছেন অভিভাবক সহ এলাকাবাসীও। অভিভাবকদের চোখেও বিষয়টি ভাল লেগেছে বলে জানিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি কাদাজলে নেমে পড়েছে স্কুলের পোশাক পরা ৭০টি ছেলেমেয়ে। যত্ন করে জমির আগাছা পরিষ্কার করে মই দিয়ে জমি সমানও করে তারা। এরপর জমির আইলে এনে রাখা ধানের চারা নিয়ে রোপর করে। একজন অভিজ্ঞ কৃষকের দিকনির্দেশনায় দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ৩৫ শতক জমিতে ধানের চারা রোপণ করে নজির সৃষ্ঠি করে এই খুদে চাষিরা।

ওই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার, মুন্নি আক্তার ও ইমু আক্তার বলেন, বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের নাম, ‘ফসলের ডাক’। ফসল বোনা, পরিচর্যা, সংরক্ষণ, হরিধান ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ আছে সেখানে। ‘বাবাও কৃষক। কিন্তু কখনো মাঠে গিয়ে তাকে সাহায্য করিনি। এখন থেকে বাবাকে কৃষিকাজে সাহায্য করব।’ তার সহপাঠী নাফিস ইকবালের বাবাও কৃষক। সে বলল, ‘ভেবেছিলাম, আমি শুধু পড়াশোনা করব। বাবা কাজ করবেন। নিজে ধান রোপণ করতে গিয়ে সে ভুল ভেঙেছে।’

সম্প্রতি ব্যতিক্রমী এই কাজের নেপথ্যে ছিলেন জেলার আটপাড়ায় খিলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিজ্ঞানের শিক্ষক শাকিল আহমেদ। তিনি একাজের পর সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। পাঠ পরিকল্পনামতো একদিন সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞানের ক্লাসে হাজির হলেন কৃষক হারিজ উদ্দিন। শিক্ষার্থীদের শাকিল আহমেদ আগের দিনই বলে রেখেছিলেন এক ‘অতিথি শিক্ষক’ আসার কথা। কৃষক হারিছকে সামনে পেয়ে শিক্ষার্থীরা একের পর এক প্রশ্ন ছুড়তে লাগল। প্রথম দিকে জড়তা থাকলেও ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে উঠেন অতিথি শিক্ষক কৃষক হারিছ। অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে নিজের মতো করে শিক্ষার্থীদের কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করলেন।
শিক্ষার্থীরা এবার নিজ হাতে ফসল বুনতে প্রশ্নের জবাবে সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলে। শাকিল তখন বিষয়টি নিয়ে প্রধান শিক্ষক এবং কৃষক হারিছের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তারাও ইতিবাচক সাড়া দিলেন। কিন্তু তত দিনে বোরো মৌসুমের চারা রোপণের সময় পার হয়ে যাওয়ায় আমন মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

শিক্ষক শাকিল আহমেদ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই একজন শিক্ষার্থী যদি জানে জমিতে ফসল বোনা, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ কিভাবে করতে হয় তাহলে এটা তাকে আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করবে। একাজে জড়িত হয়ে সে কখনো কৃষি পেশাকে ছোট করে দেখবে না। নিজের কাজ নিজে করে আনন্দও পাবে। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে হাতে-কলমে কাজ শিখলে তা জীবনভর কাজে লাগে। এ জন্যই তাদের মাঠে নিয়ে এসেছি।

মাঠে শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দেওয়া ওই কৃষি জমিটির মালিক কৃষক হারিজ উদ্দিন বললেন, ‘এই ছেলেমেয়েরা আমার কয়েক হাজার টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছে। এরা এতভালো ভাবে কৃষি কাজ করবে ভাবতে পারিনি।’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক খায়রুল আলম বলেন, ‘এই কাজের মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তা পারিবারিক কাজকর্মে প্রয়োগ করলে পরিবার খুব উপকৃত হবে। এই বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে আজকাল অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারসহ নানা বাজে অভ্যাসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ দলবদ্ধ হয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। এসব থেকে সমাজকে রক্ষা করতে এই ধরনের কার্যক্রমের বিকল্প নেই।’

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল গফুর বলেন, ‘খিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো যদি প্রতিটি স্কুল ছেলেমেয়েদের এভাবে শেখায় তাহলে শিক্ষার্থীরা স্বনির্ভর হবে, দেশও এগিয়ে যাবে। ষষ্ট থেকে সপ্তম শ্রেণিতে এই ধরণের নতুন কারিকুলাম যুক্ত করা হয়েছে। ওই স্কুলের মতো প্রতিটি স্কুলে হাতে কলমে শিক্ষা চালু দরকার বলে দাবী করলেন তিনিও।

নেত্রকোণার কলমাকান্দায় জন্ম ওই স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক শাকিল আহমেদের। নেত্রকোণা সরকারি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক হয়েছেন ২০১১ সালে। পরের বছর সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন উন্মেষ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। খিলা উচ্চ বিদ্যালয়ে আসেন তার বছর তিনেক পর।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।