বীর মুক্তিযোদ্ধা লোক গবেষক গোলাম এরশাদুর রহমান আর নেই ! ইন্নালিল্লাহি—রাজিউন

বিশেষ প্রতিনিধি: বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও লোকসাহিত্য গবেষকগোলাম এরশাদুর রহমান আর নেই! ইন্নালিল্লাহি —রাজিউন।
তাঁর জন্ম- ১৯৪৮ সনের ১০ জানুয়ারি, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোণা। তিনি ১৯৬৬ সালে মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৯ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৭১ সনে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৬২ সালে তিনি মোহনগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত তিনি নেত্রকোণা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি নেত্রকোণা জেলা মুজিব বাহিনীর (বি.এল.এফ) কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি জেলা জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি জেলা জাসদের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় জাসদের সহসভাপতি ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
ছাত্র জীবন থেকেই তিনি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি জীবনে প্রায় অর্ধ শতাধিক নাটকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
রাজনৈতিক কারণে তাকে বহুবার হুলিয়া মাথায় নিয়ে নেত্রকোণার প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে পলাতক জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। এতে গ্রামীণ জীবনের সাথে তাকে আরো নিবিড় সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করেছে। মূলত তার এই পলাতক জীবনের অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তিনি লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও গবেষণা করেছেন ।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সমূহ হলো- নেত্রকোণার বাউল গীতি, মুক্তি সংগ্রামে নেত্রকোণা, নেত্রকোণার লোক গীতি পরিচয়, নেত্রকোণার লোকায়িত গল্প গুজব। উপন্যাস – সোমেশ্বরির তীরে।

মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান: তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তিনি তখনকার মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকার কারণে, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব থেকে শুরু করে যুদ্ধকালীন সময় ও বিজয়ের সময় প্রতিটি কর্মকান্ডে,মিছিলে , সভায় তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ও নেতৃত্ব ছিল।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে দেশের রাজনৈতিক উত্তাল পরিবেশ -পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ও ছাত্র যুব নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতির জন্য নেত্রকোণার গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েন। সেই লক্ষ্যে সর্বজনাব শামসুজ্জুহা, সাফায়েত আহমদ খান, গোলাম এরশাদুল রহমান, হায়দার জাহান চৌধুরী , গোলজার হোসেন, আশরাফ আলী খান খসরু, আমিরুল ইসলাম, গাজী দেলোয়ার হোসেন, আঃ রহিম, জহিরুল হক হীরা, নির্মল কুমার দাশ, নজরুল ইসলাম খান ও জসিম উদ্দিন, ১৯৭০ এর বিজয়ী সংসদ সদস্যদের নিয়ে ফজলুর রহমান খান, জামাল উদ্দিন আহমেদ, শহিদ উদ্দিন আহমদ, আব্দুল মান্নান, এনআই খান সহ জেলার সর্বত্র শতাধিক জনসভায় স্বাধীনতার চেতনাকে শাণিত করার লক্ষ্যে বক্তব্য দেন।
উল্লেখ্য যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নেত্রকোণার তিনটি জাতীয় পরিষদের আসনে আঃ মমিন, জোবেদ আলী, সাদির উদ্দিন আহমেদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সকল আসনে আঃ খালেক, হাদিস উদ্দিন চৌধুরী, ডাঃ আখলাক হোসেন, আব্বাস আলী খান, আব্দুল মজিদ তারা মিয়া, নজমুল হুদা বিপুল ভোটে ৬ দফা ও ১১ দফার সমর্থনে জয়লাভ করেন।
নেত্রকোণা সহ গোটা দেশ যখন উত্তপ্ত-সেই সময়ে ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান রেডিও ঘোষণায় ৩ মার্চ নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। ঠিক সেই সময় নেত্রকোণার বড় বাজারে চলছিল শহর ছাত্রলীগের সম্মেলন। এই সম্মেলন প্যান্ডেল থেকে প্রথমেই উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার ডাইরেক্ট শ্লোগান। এই প্যান্ডেলে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও নাজিম উদ্দিন, নেত্রকোণা মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম এরশাদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক হায়দার জাহান চৌধুরী সহ নেত্রকোণার সর্বস্তরের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃ বৃন্দ। এই মিছিল দেখতে দেখতেই ছাত্র মিছিল থেকে গণমিছিলে রূপান্তরিত হয়। উত্তেজিত ছাত্রজনতা নেত্রকোণা কালেক্টরেড ভবনের পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা সহ বিভিন্ন অফিস আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উড়ানো পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে ফেলে। এ সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চল থেকে আসতে শুরু হয় মিছিলের পর মিছিল। সমস্ত থানা সদরগুলোতে পাঠানো হয় গণ সংগ্রাম গড়ে তোলার জরুরী নির্দেশ। এই মিছিল নিরস্ত্র ছিল না-মিছিল ছিল লাঠিসোটা, বল্লম, কাতরায় সজ্জিত সশস্ত্র জঙ্গী মিছিল। মোক্তারপাড়া মাঠে সংক্ষিপ্ত ভাষণের মাধ্যমে ছাত্রলীগ সভাপতি গোলাম এরশাদুর রহমান কৃর্তক মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণা করে। সন্ধ্যায় পরবর্তী কর্মসূচী গ্রহণের জন্য নেতৃত্বিবৃন্দকে নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার আহব্বান জানান। মেহের আলী, জামাল উদ্দিন আহমেদ, শামসুজ্জুহা, সাফায়েত আহমেদ খান প্রমূখদের ভূমিকা ছিল ছাত্রলীগের কাছে উপদেষ্টা তুল্য। আর গোটা গণসংগ্রাম চলছিল ছাত্রলীগের নেতৃত্বে।
২৩ মার্চ মোক্তারপাড়া মাঠে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলার সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে বাংলার মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা। চিরবিদায় নেয় “পাকসার জমিন সার” জাতীয় সঙ্গীত ও চাঁনতারা খচিত সবুজ নিশান। ঐ দিন ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানী পতাকা অনুষ্ঠানিক ভাবে আগুনে জ্বালিয়ে দেয় ও স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলন করেন জনাব এন.আই.খান তৎকালনি পৌরসভার চেয়ারম্যান। পরে মাঠে নবগঠিত জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ প্রদর্শিত হয়। জয় বাংলা বাহিনী প্রধান শামসুজ্জুহার নেতৃত্বে বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াচ সহ সারা শহর প্রদক্ষিন করে।
১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর আটপাড়া, থানা সদর থেকে পাক সেনাদের একটি দল রাজাকার বাহিনীসহ রাজখালী নদী অতিক্রম করার চেষ্টা চালালে গোলাম এরশাদুর রহমান, খন্দকার আনিসুর রহমান ও মীর্জা তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে পরিচালিত বিএলএফ বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের সম্মুখীন হয়। এই খন্ড যুদ্ধে ৩ জন রাজাকার গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণল হারায়।
এই ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোণা জেলার প্রায় তিন হাজার ছাত্র-যুবক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। তাছাড়া আমিরুল ইসলাম ওয়ারলেস সেটসহ গোলাম এরশাদুর রহমানের সঙ্গে ওয়ারলেস টীমসহ জেলা সর্বত্রই সংবাদ সংগ্রহ করে হেড কোয়াটারে পাঠান। বোয়ালীর হাছান চৌধুরীর বাড়ী ও করাছাপুরের সিদ্দিক মিয়ার বাড়ী ছিল ওয়ারলেস সেন্টার। ওয়ারলেস পরিচালনায় আমিরুল ইসলামের গুপনীয়তা ছিল খুবই প্রসংসনীয়।
১২ ডিসেম্বর ছাত্র লীগের ও বিএলএফ এর যৌথ উদ্যোগে মোক্তারপাড়া মাঠে অনুষ্ঠিত হয় গোলাম এরশাদুর রহমানের সভাপতিত্বে ও হায়দার জাহান চৌধূরীর পরিচালনায় লক্ষ লোকের বিজয় সভা। সকলের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় আমাদের জাতীয় সংঙ্গীত- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।

তাঁর স্ত্রী হাসিনা রওনক ও দুই ছেলে গোলাম কামরাজ কাফী, গোলাম সাদ্দাম রাফি নেত্রকোণা শহরের সাতপাই, নদীড়পাড়, কালীবাড়ী রোডে নিজস্ব বাসভবনে বসবাস করছেন। তৎকালীন জেলা মুজিব বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী  জানান, মুক্তিযুদ্ধে এরশাদুর রহমান নেত্রকোণা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নামাজে জানাযা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন ব্যবস্থা করা হবে।  তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।