
প্রযুক্তিখাতে নারীর অংশগ্রহণ কতটা প্রয়োজন তার অন্যতম দৃষ্টান্ত এই যে আজও এ নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে, লিখতে হচ্ছে। বেগম রোকেয়া তার ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে বলেছিলেন স্বামী যখন সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন স্ত্রী তখন বালিশের ওয়ারের দূরত্ব মাপেন। সত্যিই তো, সমস্যা কী এমন হতো যদি প্রযুক্তিতে নারীদের পদচারণা নিষিদ্ধ হতো ? তখন না হয় বৈশ্বিক উষ্ণতা, চিকিৎসায় নিত্যনতুন উদ্ভাবন,সাইবার নিরাপত্তা, প্রভৃতি সমাজের সর্বোৎকৃষ্ট পরিবর্তনগুলো পুরুষরাই নিয়ন্ত্রণ করবেন।
প্রথমত, মেয়েদের প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট দাবিদাওয়া উথ্থাপনের প্রতিনিধি হিসেবে নারীর সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ। নারী নেতৃত্ব অন্য নারীর সুযোগ সুগম করে।পুরুষ আধিপত্যে মেয়েরা ছোট ছোট সেক্টরে কাজ করতে আগ্রহী নয়।আজ যদি প্রযুক্তিতে লিঙ্গ বৈষম্যহীন পরিবেশ বিরাজমান হতো তবে আর অভিভাবক পর্যায়ে দ্বিধাবিভক্তি ঘটতো না।এ খাতে অন্তর্ভুক্ত অল্প সংখ্যক মেয়ে নিজস্ব ভুবনেই নিজেদের বহিরাগত ভাবেন।
দ্বিতীয়ত,মেয়েদের ব্যবহার্য সামগ্রীর ডিজাইন তো ছেলেরা সঠিকভাবে করতে পারবে না, বিশেষষত যে উপাদানসমূহ শুধু মেয়েদেরই প্রয়োজন। লক্ষ্যণীয় যে অসমতা সত্ত্বেও মেয়েরা সামাজিক রেভেনিউ ওউৎপাদন বৃদ্ধি, নারীর কর্মসংস্থান, ভিন্ন মাত্রিক শক্তি স্তর, গতিশীলতা, স্বকীয়তা বজায় রাখা, সৃজনশীলতা, বৈচিত্র্যময় পদ্ধতি উন্মোচন ইত্যাদিতে অবদান রাখছে। সম্প্রতি ইইউ’র এক সম্মেলনে উঠে আসে যে ডিজিটাল সেক্টরে নারীর অধিকতর উপস্থিতি সংস্থাটির বার্ষিক জিডিপি ১৬ বিলিয়ন ইউরো বাড়াতে সক্ষম! বাংলাদেশ সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে ২০২৬ সালের মধ্যে প্রযুক্তিক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ নারী চায়। উপরন্তু, মেয়েদের বিশেষ কিছু গুণাবলি আছে যা প্রযুক্তিখাতকে সহায়তা করবে।যেমন-মাল্টিটাস্কিং, ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স,জটিল পরিস্থিতির সহজ সমাধান, পারস্পরিক হৃদ্যতা তৈরি, একঘেঁয়েমী দূরীকরণ, নমনীয়তা, দায়িত্বশীলতা, অভিযোজন ক্ষমতা, দলগত কাজে পারদর্শীতা, ক্রেতাবান্ধবতা, ব্যবস্থাপনা এবং ক্রান্তিকালীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ।দিনশেষে নারীরও একটা সতন্ত্র পরিচয় প্রয়োজন।
যুগ যুগ ধরে ধারণা করা হয়েছে যে মেয়েরা কেবল শিক্ষকতা, নার্সিং, বা সেবা খাতে ভাল অবদান রাখতে পারে। আশেপাশের মানুষ আজেবাজে মন্তব্য করে, তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে বলে, কাঁধে চাপানো হয় ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা । কখনওবা মেয়েরাই মেয়েদের প্রতিবন্ধক। মেয়ে বলে বেতনে বৈষম্য প্রকারান্তরে আমাদের সাংগঠনিক স্বচ্ছলতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।যত উপরের পোস্টে যাওয়া যায় সমান বেতন পাওয়ার সম্ভবনা ততই যেন ম্লান হয়ে আসে।এছাড়া কর্মক্ষেত্রে অপব্যবহার তো আছেই।সাইবার বুলিং এর শিকার শতকরা ৮০ শতাংশ নারী, যাদের অধিকাংশই ন্যায় বিচার পায় না। ‘মেয়ে হলে ডাক্তার,ছেলে হলে ইন্জিনিয়ার’-এ যেন পারিবারিক শ্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছে।মেয়ে ইন্টেলেক্টুয়াল বললেই তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ট্রেন ড্রাইভারের চিত্র।একেবারে শুরু থেকেই, ছোট্ট ছেলেদের হাতে তুলে দেওয়া হয় যাবতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক খেলনা, পক্ষান্তরে মেয়েদের কাছে শোভা পায় মায়াবর্ধক সামগ্রী। মেয়েদেরকে বেশি এক্সপ্লোর করতে নিরুৎসাহিত করা হয়।অধিকন্তু, পার্লারের কাজেতাদের যত সহজভাবে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া হয় প্রযুক্তিতে তত না।বলা বাহুল্য, সময় সাপেক্ষ কাজে নারীর অংশগ্রহণ আরও সীমিত। ইন্টারমিডিয়েট কিংবা ভার্সিটি পর্যন্ত বিজ্ঞান শাখায় পড়ে কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মানে রাষ্ট্রীয়সম্পদের অপচয়।
যারা মাতৃত্ব বইতে জানে তাদেরকে কোন বাধা দমিয়ে রাখবে? অযোগ্য হলেও নারী কোটায় সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য এটা কোন অন্যায় আবদার নয়, বরং অনুনয় যেন যোগ্য হওয়ার পরও শুধু মেয়ে হওয়ায় কেউ যেন বঞ্চিত না হয়। একটু সাহায্য পেলে সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়ার অনন্যসাধারণতাকে যেন অঙ্কুরে পিষে ফেলা না হয়।মেয়েরা কেন পিছিয়ে থাকবে? তারা নিজেও জানে না সংসারে তাদের অবদান কতখানি,কী প্রচন্ড মনস্তাত্বিক চাপ মোকাবেলা করেন! এর একাংশ প্রচেষ্টা তারা যদি প্রযুক্তিখাতে দেন, তাহলে পুরো রাষ্ট্রই নিদারুণ লাভবান হবে। আজ প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে মেয়েদের অপারগতাকে বায়োলজিক্যাল আখ্যা দিয়ে মানোন্নয়নের প্রক্রিয়া স্লথ হতে পারে,তবুও ইতিহাস সাক্ষী আছে প্রথম প্রোগামার একজন নারী, প্রারম্ভিক কম্পাইলার নিয়ে কিংবা নাসায়ও কাজ করছেন নারী বিশেষজ্ঞরা।এখন তো আর তলোয়ার হাতে যুদ্ধ করার প্রেক্ষাপট নেই,সুইচ টিপলে যন্ত্র কাজ করে,প্রোগ্রাম ঠিক ভাবে লিখলেই রান করে; এমন তো নয় যে মেয়ে লিখলে আগেই নাকচ করে দেবে। মেয়েরা যোগ্যতা বলে প্রযুক্তিকে বেছে নেয়, প্রযুক্তি দয়াপরবশ হয়ে মেয়েদের চাকরি দিচ্ছে এমন নয়। প্রযুক্তিখাতে মানদন্ড একটাই-মেধা।
গবেষণার সর্বশেষ সংযোজনে নারীর সুপ্ত ধৈর্য অর্থনৈতিক বলিষ্ঠতার নব-সম্ভাবনা উন্মোচন করবে। সামরিক, প্রশাসনিক, কৃষি, কুটির শিল্প ইউটিউব মিডিয়া কিংবা মহাকাশে কি মেয়েরা যায়নি? গত ৫০ বছরে মানবসম্পদ উন্নয়নে, তৈরি পোশাক শিল্পে অনন্য অবদান রেখেছেননারীরা।বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী নারী উদ্যোক্তার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য । এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে চলমান ই-কমার্স, ই-গভর্নেন্সে নারীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করছে।ফলশ্রুতিতে কাজের বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি হচ্ছে।সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট,গ্রাফিক্স ডিজাইন, বিজনেস স্টার্ট আপ আর ডিজিটাইজেশনে নারীর বর্ধিষ্ণু অংশগ্রহণে নজিরিহীন সাফল্য অর্জিত হয়েছে । ডিজিটাল ডিভাইড হ্রাসকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ একই সঙ্গে নারী ও প্রযুক্তিখাতকে এগিয়ে নেবে বহুদূর। কর্পোরেট জব নারীদের জন্য বেশ লোভনীয়, তাছাড়া বাস্তবতাএমনও নয় যে কেবল সায়েন্স বেকগ্রাউন্ড থেকেই একাজে আসা যাবে।
কর্মক্ষেত্রেই কেবল কম, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা অথবা একাডেমিক রেজাল্টে কিন্তু বরাবরই মেয়েরা অগ্রসর। পিইডবলিউ রিসার্চ সেন্টারের সূত্রমতে, আমেরিকায় ৬২ শতাংশ নারী পোস্টগ্রেড ডিগ্রি অর্জন করলেও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে একশতে মাত্র ২২ জন। সত্যি বলতে মেয়েদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, হীনম্মন্যতা, প্রকারান্তরে মেয়ে শব্দটাই ভুলে যাওয়া উচিত।ইতিবাচক কাজে নিজের দক্ষতা উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।সাহায্য চাইতে ও খুঁজে পেতে জানতে হবে, হাঁটা হয়নি এমন পথে হাঁটতে হবে সাহসের সঙ্গে। সেইসাথে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন কাম্য।মানবতার কল্যাণে নারী প্রতিভাকে কাজে লাগানো দরকার। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে জনগোষ্ঠীর আধেক অংশের উপস্থিতি এমন ম্রীয়মান হলেচলবে কেন। কোনঠাসা করে না রেখে নারীর জ্ঞানকে উন্নয়নের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্তি আবশ্যক। নারীর সম্পৃক্ততা ইতোমধ্যে প্রভূত উন্নয়নের সাক্ষী। অগ্রগতির ধারা ক্রমবর্ধমান রাখতে এই সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।নারীই পারে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা,দক্ষ জনশক্তির অভাব পূরণ এবং যোগ্যতমের ব্রেন ড্রেন ঠেকাতে। -নিশাত তাসনিম, শিক্ষার্থী, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়