অন্তরাশ্রমের সাধক কবি এনামূল হক পলাশ এর ৪৫তম জন্মদিন আজ 

বা/নে সাহিত্য রির্পোট: প্রথার জীবন ভেঙ্গে তিনি সুফির মতো হেঁটে বেড়ান নেত্রকোণা শহরে। অতি সাধারণ বেশভূষা অথচ ব্যতিক্রম তার স্টাইল। তিনি কবি এনামূল হক পলাশ। কেউ তাকে ডাকেন সাধু, কেউ ডাকেন অঅন্তরাশ্রমের কবি, কেউবা ডাকেন মির্জা গালিব। কবি এনামূল হক পলাশ বাংলা ভাষার সহজিয়া ধারার একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি। একাধারে তিনি একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও শিশু সাহিত্যিক। তিনি অন্তরাশ্রম নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং একই নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিচালনা করেন।

কবি এনামূল হক পলাশ ১৯৭৭ সালের ২৬ জুন নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার বাদে চিরাম গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস একই উপজেলার বামনগাঁও গ্রামে। পিতা মরহুম এমদাদুল হক, মাতা- নুরুন্নাহার হক।
১৯৯৪ সালে উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী থেকে প্রকাশিত মাটির সুবাস নামক একটি পত্রিকায় তাঁর একটি কবিতা প্রকাশিত হয় যা ছিল ছাপার অক্ষরে তাঁর প্রথম কবিতা। প্রকাশিত কবিতার জন্য তিনি মনি অর্ডার যোগে চল্লিশ টাকা সন্মানী প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
২০০৯ সালে কবির প্রথম বই “অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ চাই” প্রকাশিত হয়। এছাড়া এখন পর্যন্ত জীবন এক মায়াবী ভ্রমণ, অন্ধ সময়ের ডানা, অন্তরাশ্রম, মেঘের সন্ন্যাস, পাপের শহরে, জল ও হিজল, তামাশা বাতাসে পৃথিবী, অখন্ড জীবনের পাঠ, লাবণ্য দাশ এন্ড কোং সহ মোট দশটি কাব্যগ্রন্থ ও বইয়ের পাতায় ফুলঝুরি, কলমিলতার ফুল, মগড়া নদীর বাঁকে নামে তিনটি শিশুতোষ কবিতার বই এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার সরল পাঠ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনি প্রাচীন আরবি সাহিত্যের কিছু কবিতা অনুবাদ করেছেন। তার দুটি অনুবাদ গ্রন্থ হচ্ছে, ধর্ম বিশ্বাস আখ্যানের মতো সুন্দর এবং মু – আল্লাক্বা।
২০১৬ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রতিষ্ঠিত নেত্রকোণার মালনী এলাকায় বিশ্ব কবিতার আবাসস্থল বা হোম অব ওয়ার্লড পয়েট্রি খ্যাত “কবিতাকুঞ্জ” প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে অবকাঠামো গঠনের কাজে যুক্ত থেকেছেন এবং একই প্রতিষ্ঠানের প্রথম পরিচালক হিসেবে কবি কর্তৃক নিযুক্ত আছেন। ২০১৭ সালে কবি, লেখক ও সংস্কৃতি কর্মীদের ব্যবহারের জন্য তিনি নেত্রকোণা শহরের মালনী এলাকায় গড়ে তুলেছেন “অন্তরাশ্রম” নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য। ২০১৭ সালে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার চর্চা সাহিত্য আড্ডা কর্তৃক তাদের শততম আসরে অন্যান্যদের সাথে “চর্চা শুভেচ্ছা সন্মাননা- ২০১৭” প্রাপ্ত হন। ২০১৮ সালে কবির চল্লিশ পূর্তি উপলক্ষে কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে “আশ্রম পাখির মায়াপথ” নামে একটি প্রকাশনা গ্রন্থ বের হয়। ২০১৯ সালে তিনি নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ‘কুপি বাতি ‘ নামে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেন। ভাস্কর্যটি তৈরি করে দিয়েছেন বিখ্যাত ভাস্কর অখিল পাল। ২০২২ সালে তার কিছু কবিতা নিয়ে ইংরেজিতে ভাষান্তরিত বই CROSSING FORTY NIGHTS পশ্চিম বঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়।
কবি এনামূল হক পলাশ সম্পর্কে প্রগতিবাদী প্রাবন্ধিক ও লেখক অধ্যাপক যতীন সরকার বলেন, “একবারে নিজস্ব ব্যক্তিগত বোধ থেকে শুরু করে সামাজিক সমস্যা-সংকট পর্যন্ত সবকিছুর মর্মানুধাবনে পলাশ অনন্যতার প্রকাশ ঘটাতে পেরেছ- ‘স্টাইল ইজ দি ম্যান’ কথাটির জীবন্ত উদাহরণ হয়ে উঠেছে তার প্রতিটি কবিতা। পলাশের কাব্যগ্রন্থের যে কোন পাঠকই কবিতার নতুন স্বাদ উপভোগ করে তৃপ্ত হতে পারেন বলে আমি মনে করি।” কবি সরোজ মোস্তফা বলেন, “এনামূল হক পলাশের কবিতা ‘সরল বয়ানে ক্ষত-বিক্ষত জীবনকে তুলে ধরে, সর্বনাশা সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি জীবনের অখন্ড অনুভবকে তুলে ধরেন, এটাই তার স্টাইল। তার কবিতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পঙক্তিগুলো কবির মুখ ও মানবের জীবনের আয়না।” এদিকে শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকার কবি এনামূল হক পলাশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন, “সমকালীন সমাজ, বিশ্ব রাজনীতি, ঐতিহাসিক পরমার্থ, সসীম মানুষের অসহায়ত্ব, আধুনিক শিল্পীর অন্ধত্ব ও কৃষকের দুরবস্থাকে অতিক্রম করে এই লেখক মানবজীবনের সফলতার স্তব বর্ণনা করেছেন।” মানবিক ও প্রকৃতি প্রেমিক এই কবি সম্পর্কে কবি মামুন খান বলেন, “এনামুল হক পলাশ। আমাদের ভাই ও বন্ধু। আপাদমস্তক একজন কবি। স্বাপ্নিক, বিপ্লবী, বন্ধুপ্রাণ, চঞ্চল এবং কর্মবীর একজন মানুষ। বহুরৈখিক এই মানুষটি থেমে থাকতে জানেন না। এক সঙ্গে বহু পথে হাটতে এবং বহুজনকে নিয়ে চলতে ভালবাসেন। একাধিক গন্তব্যে ধাবিত হওয়াটা তাঁর নেশা ও আনন্দ। এক্ষেত্রে ব্যর্থতা নিয়ে তাঁকে ভাবতে দেখিনি। ব্যর্থ হলেও কোনো কালিমায় তাঁর মুখ কালো বা করুণ হতে দেখিনি। যখন লেখেন দুহাত ভরে লেখেন। কি হলো না হলো- না ভেবে প্রাণের পংক্তিগুলোকে মর্যাদার সাথে সাজিয়ে রাখেন কবিতার উদ্যানে। নিমগ্ন অনুধ্যানে যখন ফুল ফোটান ছাদবাগান বা বারান্দায়- তিনি নিজেও পুষ্প হয়ে যান। নিজের ফোটানো ফুলের মতই তাঁর মুখ হাসতে থাকে জগতের হাওয়ায়। যখন পাখি পোষেন, এমন এক কিচিরমিচির ঘোর তাঁর চোখে মুখে- যেন পৃথিবীর সমস্ত পাখি তাঁর জন্মসহোদর। যেনো তিনি নিজেও এক বন্দীপাখি এই জীবন-সংসার খাঁচায়।”
প্রাবন্ধিক ও লেখক অধ্যাপক বিধান মিত্র বলেন, “এনামূল হক পলাশ, আপাদমস্তক কবি-মাটির কবি, মানুষের কবি; জীবনের কবি, মরমের কবি। এনামূল হক পলাশ বঙ্কিম-কথিত উৎকর্ষ আদর্শ সামগ্রীর কাব্যিক-শরীর দানকারী সৃষ্টিশীল কবি। আমাদের বোধ ও বিদ্যায় জনসনতত্ত্বকে স্থাপন করে আমরা যদি এনামূল হক পলাশরচিত কবিতাগুলো পড়ি, তাহলে দেখবো-তিনি যা লিখেছেন, সবই পলাশ-রাঙানো কবিতা, রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় কবিতা, ‘কবিতা নয়’ (বা কবিতা হয়ে ওঠেনি) এমন একটা লেখাকেও তিনি ‘কবিতা’ হিসেবে চালিয়ে নেবার দুশ্চেষ্টা করেননি। বর্তমান আধুনিক কবিতার হরেক রকম ‘তত্ত্ব’ ও ‘বাদ’ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি তাঁর ভাবনাপূঞ্জকে পাঠক-বোধাতীত জগতে নিয়ে যাননি, কবিতার ভাব-লয়-দেহকে তিনি বরাবরই মাটি ও মানুষ সংলগ্ন রেখেছেন, ভাবের জগতকে চোরাবালির ফাঁকে নিয়ে যাননি, সাধারণ পাঠকের মেধা ও বোধকে ‘পরীক্ষার’ আসনে বসাননি।” কবি কানিজ মাহমুদ বলেন, “একটি নতুন দিনের স্বপ্ন দেখি আমরা সবাই। দেখতে দেখতে স্বপ্নটাই পুরানো হলো,তবু স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো, বাস্তবায়নের কিছুই হলো না। স্বাপ্নিকরা ও ক্লান্ত এখন কেউ বা নিরাশ হয়ে ফিরে গেছেন। কেউ বা সিঁড়ি ডিঙিয়ে স্বপ্ন ছোঁয়ার আহবানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রলুদ্ধ করছেন।যাদের স্বপ্ন দেখা বা দেখানো শেষ হয় না তারাই কবি,আজন্ম স্বপ্নদ্রষ্টা। পরিবার, সমাজ ,রাষ্ট্রের নানা অসংগতির বিরুদ্ধে দাড়িয়ে থাকেন আপোষহীন। এমন’ই এক আপাদমস্তক কবি এনামূল হক পলাশ।”
সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর শীতাংশু কুমার ভদ্র বলেছেন, “জ্ঞান ও কর্মে ছাত্রের নিকট পরাস্ত হওয়াই শিক্ষকের অহংকার। আমি সেই অর্থে অহংকারী। সাহিত্য ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড, সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি, প্রকৃতি প্রেমী, পরিবেশ বান্ধব-কর্মসূচীতে স্বকিয়তা, সত্যকথা অকপটে বলা, বন্ধু বাৎসল্য, পরিবার পরিজনের সংগে সদ্ভাব, সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ ও সুশিক্ষার প্রয়াস, প্রকৃতির প্রতি মায়া, বিরল প্রজাতি উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণে তৎপরতা, নিজ আবাসে জীবের সমাহার ঘটানো এবং সুবিধা বঞ্চিত সরল গণমানুষের জন্য সহযোগিতার হাত তার প্রসারিত। মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে তার আত্মতৃপ্তি জেনে আমি খুবই খুশী হই এবং গর্ববোধ করি। কবি সজল অনিরুদ্ধ বলেন, “অন্তরাশ্রমে বেদনায় ক্লিষ্ট কবি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু, না। এই সন্ন্যাসে গিয়ে কবি যেন আরও বেশি সমাজ সচেতন হয়ে উঠেছেন। ভুলে যাননি তার হাড় জিরজিরে কৃষকের কথা। ভুলে যাননি বিপন্ন মানুষের কথা। মানুষের জন্যই, মানবতার জন্যই কবির এই সন্ন্যাস গ্রহণ। আমিত্বকে ছেড়ে মানুষ যখন সর্বজনীন হয়ে উঠে তখন তার শক্তির প্রতাপ আরো বাড়ে। আমাদের মেঘের সন্ন্যসী সেই শক্তি অর্জন করেছেন।” তাছাড়া কবি পলিয়ার ওয়াহিদ বলেন, “তিনি নিজস্ব জনপদের মুখের ভাষাকে কবিতায় স্থান দিয়েছেন বুক উঁচু করে। গোয়ো আর আঞ্চলিক তকমাকে গায়ে না মাখিয়ে উল্লাসে প্রকাশ করেছেন কবিতার আপন বৈভব। কি অসাধারণ উপমায় আধুনিক সংসারকে ইঙ্গিত করলেন। সত্যি বিস্মিত না হয়ে পারি না। এনামূল হক পলাশ ভাইয়ের কবিতা মূলত পাঠের, তা লিখে বোঝানো সত্যিই বোকামী। প্রতিটি কবিতা তিনি দর্শনরসে চুবায়ে পরিবেশন করেন সাদামাঠাভাবে। আর এখানেই তার মুন্সিয়ানা ধরা পড়ে ষোলআনা। এতো সহজ ভাষায় প্রকাশ করেন যে, পাঠের পর রয়না মাছের মতো ফাঁদে হা হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না!”
কবি এনামূল হক পলাশ সহজের সাধনা করেন। সাধারণ হয়েই থাকতে চান মানুষের কাছে। তিনি মনে করেন নিজের গাছ থেকে নিজের অক্সিজেন সংগ্রহ করবেন। তাঁর ছাদ ঘুরে দেখা গেছে ছোট ছোট চৌবাচ্চায় শাপলা- পদ্ম ফুটে আছে। ছাদে পদ্ম ফুটিয়েছেন বলে কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর বাসস্থানের নাম দিয়েছেন স্থলপদ্ম। বর্তমানে তিনি বসবাস করেন সেখানে।
তাঁর সাথে কথা বললে তিনি জানান, জীবনের বিচিত্রতা আমাকে দিন দিন সহজ হওয়ার সাধনার দিকে নিয়ে গেছে। তাই সহজের সাধনা করি। আমি সাধু নই। সাধু হতেও চাইনা। সহজ হতে চাই। অন্তরাশ্রমের পথ বেয়ে পৃথিবীর পথে পথে ছড়িয়ে দিতে চাই ভালোবাসা ফুল।
কবির ৪৫ তম জন্মদিনে আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।