স্মরণ: জীবনবাক্যের কবি নূরুল হক – এনামূল হক পলাশ

স্মরণ – জীবনবাক্যের কবি নূরুল হক — এনামূল হক পলাশ

শোকে ভাসা মানুষের মতো একদল কাক বিলাপ করছে একটি মৃত কাক ঘিরে। একসঙ্গে এতো কাক জড়ো হল দেখে কার না মায়া হয় আহা! যেন চিঠি দিয়ে নিয়ে আসছে দূর সমুদ্দুর থেকে। কী সাংঘাতিক ঘটনাটি ঘটে গেল আত্মীয় বলয়ে! হায়! শোকার্ত পরিজন এরা ধৈর্যহীন কাঁদে! কবিতার নাম ” মৃতের পাশে আত্মীয়দের বিলাপ “। কবির নাম নূরুল হক। তিনি জন্মেছিলেন নেত্রকোণা জেলার মদন উপজেলার বালালী গ্রামে ১৯৪৪ সালের ২৫ নভেম্বরে। ২০১০ সালে অমর একুশে বইমেলায় ১১ ফেব্রুয়ারি লিটল ম্যাগ চত্ত্বরে কবি সরোজ মোস্তফা এই কবির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। এর আগে আমি তাঁর নাম পর্যন্ত জানতামনা। কবি আমাকে “একটি গাছের পদপ্রান্তে ” বইটি উপহার দিলেন। সেই সময় পর্যন্ত আমি বিভিন্ন ছোট কাগজে মাবুদ এনাম নাম নিয়ে কবিতা লিখতাম। নূরুল হক স্যার আমাকে মাবুদ এনাম সম্বোধন করে অটোগ্রাফ দিলেন। বইমেলা থেকে ফিরে বইটি পড়ে শেষ করার পর মনে হলো এতোদিন তিনি কোথায় ছিলেন? আগে কেন তার কবিতার সাথে পরিচিত হলাম না? বাংলা কবি ও কবিতার দুঃসময়ে নূরুল হকের মতো কবিরা আড়ালে থেকে যাওয়ায় এইসব মহান কবিদের কবিতার সুবাস থেকে আমরা বঞ্চিত হই। পাদটীকা নামের একটি কবিতায় কবি নূরুল হক ঘোষণা দেন – ” জীবন এক অপূর্ব দৃশ্য, যা দেখে মানুষ বাড়ি ফেরার কথা ভুলে যায়।” কী অদ্ভুত শিহরণ হয় এই বাক্য পাঠ করলে। জীবনকে তিনি কবিতায় ধরতে পেরেছিলেন। তাঁর কবিতার পরতে পরতে জীবন। তিনি জীবনবাক্যের কবি। কবি নূরুল হকের জীবনবাক্য আমাদের চিন্তায় বিদ্যুতের চমক জাগায়, আলোড়িত করে বোধ। “দেখি, হাওয়ার ওপর ভাসছে একটি লতা। সেই লতাই কি আমি?” জীবদ্দশায় কবি নূরুল হকের নাম অনেকেই উচ্চারণ করেননি। কবি নিজেও ছিলেন নিভৃতচারী। নিরবেই তিনি লিখেছেন – “এক নিমকহারাম পৃথিবীতে আমাদের দিন ফুরিয়ে যায়। ” মাটি আর ভাটির সন্তান কবি নূরুল হক ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। একাত্তরে হাতে নিয়েছিলেন দেশের জন্য অস্ত্র। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে জীবন বাজি রেখেছিলেন। কলেজে মাস্টারি করে কাটিয়েছেন জীবন। নিজের মতো করে জীবন এঁকেছেন, কবিতা লিখেছেন। ষাটের দশকে তাঁর কাব্যচর্চা শুরু হলেও তিনি আশির দশকে এসে উজ্জ্বল হয়েছেন বিপুল উদ্যমে। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে শাহবাগ থেকে মালোপাড়া, সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়, একটি গাছের পদপ্রান্তে, মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা, এ জীবন খসড়া জীবন। এই শতাব্দীর ভয়াবহ অতিমারি কোভিডের কালে বেশ কয়েকদিন আইসিইউতে থেকে যুদ্ধ করতেছিলেন তিনি। জীবনের অপূর্ব দৃশ্য আরেকটি বার তিনি দেখতে পাবেন বলে আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু সবাইকে আশাহত করে এই মহান কবি ২২ জুলাই ২০২১ তারিখে জীবনের মায়াবী ভ্রমণ সমাপ্ত করে চলে গেছেন নতুন জীবনের অদেখা দৃশ্য দেখতে। কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।