নেত্রকোণায় ট্রলারডুবি: আরো দুই মরদেহ উদ্ধার,মোট উদ্ধার ১২

বিশেষ প্রতিনিধি: মাত্র একমাসের ব্যবধানে নেত্রকোণায় দুটি নৌ-দুর্ঘটনা। মোট ৩০ জনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে অদক্ষ চালক, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই এবং নির্ধারিত ঘাট ছাড়া যত্রতত্র পাড়ে ভিড়ানোকেই দোষছেন স্থানীয়রা। বুধবারে কলমাকান্দার ঘটনায় নাম পরিচয়সহ চার জনকে নিখোঁজ রেখেই বৃহষ্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে স্থানীয় প্রশাসন। শুক্রবার দুপুরে এক শিশুসহ আরো দুই জনের লাশ নদীতে ভেসে উঠলে পুলিশ উদ্ধার করে। এঘটনায় এনিয়ে মোট উদ্ধার ১২ জন।

স্থানীয় এলাকাবাসীর দেয়া ও খুঁজতে আসার স্বজনদের দেয়া তথ্যমতে নিখোঁজ আছেন- ইনাতনগরের ফাতেমা আক্তার (৪৫), মোফাজ্জল হোসেন। বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল সহ ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ থেকে আসা ডুবুরিদল উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছে। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ থেকে বিআইডব্লিউটিএ এর একটি ডুবুরি দল নিখোঁজদের উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালিয়েও নিখোঁজদের উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। তবে শুক্রবার দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে রতন মিয়া (৩৫) ও মনিরা আক্তার (৪) নামে আরো দুই ব্যক্তির মরদেহ নদীতে ভেসে উঠলে পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে। উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন কলমাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল করিম।

গত ৫ই আগস্ট জেলার মদনে ট্রলার ডুবির ঘটনার ১৮ জনের শোক ভুলতে না ভুলতেই এক মাসের ব্যবধানে ফের কলমাকান্দা উপজেলার বড়খাপন ইউনিয়নের রাজনগর এলাকায় বুধবার ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই পরিবারের মা ও ২ সন্তানসহ একই গ্রামের ৭ জন জনের মৃত্যু হয়। ঘটনায় মোট ১২ জনের লাশ উদ্ধার হয়। ৬ জনকে জীবিত উদ্ধার করে এলাকাবাসী। এনিয়ে এক মাসে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

নেত্রকোণার উচিতপুর হাওরে করোনাকালীন সময়ে চলাচলে প্রশাসনের কোনো তদারকি ছিলনা বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। যদিও ঘটনার পর কোনও পর্যটককে সেখানে ভ্রমণ করতে দেওয়া হবে না এবং এলাকাবাসীকেও নৌযানে সীমিত আকারে চলাচলের জন্য বলা হয়েছিল। ঘটনার একমাস পেরুলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি কোনো আইনগত ব্যবস্থা। উচিতপুর ঘাটের স্থানীয় ট্রলার মালিকদের অভিযোগ, পঞ্চাশ টাকা ঘাট ইজারার মধ্যে জোর করে আদায় করা হয় প্রতি ট্রলারে (প্রতিদিন) এক হাজার টাকা। এসব কারণে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ে বাধ্য হয় ট্রলার মালিকরা।
উচিতপুর ট্রলার ঘাটটি কয়েক বছর ধরে পর্যটন এলাকা হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। বিভিন্ন উৎসবের সময় ছাড়াও বর্ষাকাল জুড়েই সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে থাকে ট্রলার ঘাটটি। ফলে আরো বেশি মুনাফার আশায় এখানকার নৌকা ব্যবসায়ী ও মাঝিদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের প্রতিযোগিতা। এ কারণে আগেও ঘটেছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। স্থানীয় লোকজন বলছে, এর ধারাবাহিকতায়ই ৫ আগস্ট ট্রলারডুবিতে ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
মদন ফায়ার স্টেশনের অফিসার আহমেদুল কবির জানান, ৩০ জন যাত্রীর জায়গায় প্রায় ৫০ জন যাত্রী বহন করায় এমন ঘটনা ঘটেছিল। তাছাড়া যেহেতু বর্ষাকালে যাতায়তের একমাত্র পথ নৌকা। সেকারণে এসব ঘাটে প্রশাসনিক তদারকি জোরদার করতে হবে।
সরেজমিনে মদনের উচিতপুর ঘাটে গিয়ে অন্যান্য নৌকার মাঝি ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেও একই তথ্য জানা গেছে,অনেক দিন ধরেই এখানে অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়ের ঘটনা ঘটে চলছে। কিন্তু এত দিন ধরে এসব বিষয় নিয়ে প্রশাসনের কোনো নজরদারি ছিল না। এ ছাড়া ঘটনার পর থেকে নৌকার মালিক ও মাঝির কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। প্রশাসনও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি ঘটনার একমাস পেরোলেও আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল রানা জানান, কলমাকান্দার ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মাহমুদকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন, কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল রানা, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন, কলমাকান্দা থাানর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল করিম ও কলমাকান্দা ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশন ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম। তদন্ত কমিটিকে ঘটনার কারণ সম্পর্কে সাত কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেয়া জন্যে বলা হয়েছে।
বুধবার নৌ-দুর্ঘটনায় উদ্ধার হওয়া মৃতরা হলেন, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার মধ্যনগর থানার কামাউড়া গ্রামের শিশু আল মুজাহিদ-৩, টুম্পা-৪, জাহিদ-আড়াই বছর, অনিক-৫, রাকিবুজ্জামান-২, মজিদা বেগম-৫১, সুলতানা-৪০, মোছাঃ লাকী বেগম-৩০, লুৎফুন্নাহার-২৫ ও নেত্রকোণা সদর উপজেলার মেদনী গ্রামের হামিদা বেগম-৫০।
জেলা প্রশাসক কাজী আবদুর রহমান বলেন, ২৪ ঘন্টা নাগাদ নেত্রকোণা, কলমাকান্দা, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের ৪টি ইউনিটের ৭ জন ডুবুরীসহ ২৭ জন কর্মী উদ্ধার অভিযান চালিয়েছেন। নিখোঁজদের উদ্ধারের জন্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোন খোঁজ মিলেনি। এখন তাদের খোঁজে পাওয়ার আর কোন আশা না থাকায় উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করেছি। তবে শুক্রবার দুপুরে এক শিশুসহ দুই জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।