চলে গেলেন অনাথের নাথ’ মানবকল্যাণকামী অনাথালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নয়ন যোগী

স্টাফ রিপোর্টার:‘মানবকল্যাণকামী অনাথালয়’ প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নিত্যানন্দ গোস্বামী(নয়ন যোগী) সোমবার রাত সাড়ে আটটার দিকে পরলোক গমন করেছেন। নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার চণ্ডীগড় এলাকায় এটি ‘চণ্ডীগড় আশ্রম’ বা ‘নয়ন যোগীর অনাথাশ্রম’ নামের ।

নেত্রকোনা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে দুর্গাপুর। দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পিচঢালা পথ পেরিয়ে নাজিরপুরের পথে চণ্ডীগড় গ্রাম। গ্রাম থেকে উত্তরের দৃষ্টিসীমায় তাকালে দেখা যায় সুউচ্চ মেঘালয়। আর ডানপাশে সবুজের হাতছানি। মনোরম শোভামণ্ডিত এ গ্রামের এক পাড়ার নাম ‘নাথপাড়া’। এক অনাথের স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সেখানেই গড়ে উঠেছে ‘মানব কল্যাণকামী অনাথালয়’। যাকে বলা যায় ‘শিশুস্বর্গ’। তিন একর ৩৭ শতাংশ জমির ওপর সারিবাঁধা কয়েকটি পাকা ও আধাপাকা ঘর, বাগান, পুকুর, গবাদি পশুর খামার, গ্রামীণ নারীদের শেলাই শেখার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং খোলা মাঠ নিয়ে গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। অনাথ নিবাস ছাড়াও সেখানে আছে- বৃদ্ধনিবাস, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তাদের আশ্রয়কেন্দ্র, দাতব্য চিকিৎসালয়সহ আরও অনেক কিছু।

চণ্ডীগড় ‘মানব কল্যাণকামী অনাথালয়’ এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ১১ মার্চ। গ্রামের নাথপাড়ার নিত্যানন্দ গোস্বামী প্রতিষ্ঠাতা ও স্বপ্নদ্রষ্টা। নিত্যানন্দ গোস্বামীর ডাকনাম নয়ন গোস্বামী ওরফে নয়ন যোগী। তিনি নিজেও অনাথ’। মাত্র এক বছর বয়সে মাকে হারান। বাবাকে হারান ছয় বছর বয়সে। ১১ বছর বয়সে মারা যান একমাত্র বোন। এ কারণে মামার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয় তাঁকে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস! কিছুদিনের মধ্যে মামাও চলে যান পরপারে। এরপর এক এক করে দিদিমা ও মাসির মৃত্যু তাঁকে সাগরে ভাসিয়ে দেয়। অষ্টম শ্রেণীর পাঠ চুকাতে না চুকাতে বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। বদলে যায় জীবনের গতি। এ সময় রসরাজ দেওয়ানী নামে এক সন্যাসীর দেখা পান তিনি। তাঁর দীক্ষায় সন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। শুরু করেন গাছের নিচে বসবাস। কিছুদিন পর ওই সন্যাসী তাঁকে আবার পড়াশোনার নির্দেশ দেন। এবার এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করে ফের গৃহত্যাগ করে চলে যান পাহাড়ে। এ পাহাড়-ও পাহাড় ঘুরে আদিবাসীদের মধ্যে ধর্মীয় উপদেশ বিতরণ করেন। এভাবে এক সময় চলে যান সুনামগঞ্জের শ্রী শ্রী অদ্বৈত প্রভু জগন্নাথের মন্দিরে। এর তিনবছর পর বাড়ি ফিরে উদ্যোগ নেন অনাথাশ্রম (অনাথালয়) প্রতিষ্ঠার। দুর্গাপুরের বিরিশিরি গ্রামের সুদীপ পাল, অঞ্জনা পাল এবং চণ্ডীগড়ের  সজল দেবনাথ এ তিন শিশুকে নিয়ে শুরু হয় অনাথাশ্রমের যাত্রা। এরপর দূর-দূরান্ত থেকে অনাথ শিশুরা আসতে শুরু করে। বর্তমানে মানবকল্যাণকামী অনাথালয়ে আশ্রিত শিশু-কিশোরের সংখ্যা ১১২। এরা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও উপেক্ষিত ওরাওঁ, হাজং, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, সুইপার, মাহাতো, ত্রিপুরা, বুনোবসাক, কুমি, গারো, রাখাইন, কোচ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের। ওই একশ’ ১২জনের মধ্যে ৬২জন প্রাইমারি স্কুলে, ৪০জন হাইস্কুলে, পাঁচজন কলেজে এবং পাঁচজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আশ্রম থেকেই বহন করা হয় এদের পড়ালেখার যাবতীয় খরচ।

সু-উচ্চ দালান-কোঠা নেই, ডিজিটাল গেম নেই। নেই তেমন অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা। আয়োজন অতি সাধারণ। কিন্তু এর মধ্যেই চলে শিশুদের হাসি, আনন্দ, গান ও পড়ালেখা। সব কিছু হয় রুটিন মাফিক। সকাল ছ’টায় শিশুরা ঘুম থেকে ওঠে। হাত-মুখ ধোয়ার পর সম্মিলিত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় প্রার্থনা সঙ্গীত। পরে যোগ ব্যায়াম, পিটি প্যারেড, জাতীয় সঙ্গীত এবং শপথ বাক্য পাঠ। এরপর লেখাপড়া। পড়া শেষে সকালের নাশতা। ডাল, ভাত, মাছ, মাংস, সবজি- যখন যা জোটে তা দিয়েই তৈরি হয় খাবারের মেন্যু। সকাল ১০ টায় সব শিশু পড়তে যায় স্থানীয় স্কুল-কলেজে। বিকেলে শিশুরা ফিরে এলে আশ্রমটি আবার প্রাণ ফিরে পায়। সার বেঁধে সবাই বসে যায় খাবার টেবিলে। খাবার শেষে কিছুটা বিশ্রামের পর কেউ খেলতে যায়, আবার কেউ ফুল বাগানে ৭০ প্রজাতির গোলাপ, গাঁদা, জুঁই, রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা, টগর, রঙ্গন আর গন্ধরাজের ভিড়ে হারিয়ে যায়। বিকেল কিছুটা গড়িয়ে এলে ডাক পড়ে বাদ্যযন্ত্র, সঙ্গীত ও নাচ শেখার আসরে। এরপর সন্ধ্যার প্রার্থনা শেষে সবাই নিজ নিজ পড়ার টেবিলে বসে যায়। বইয়ের পড়া, নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্রÑ সব বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেয়ার শিক্ষক আছে আশ্রমটিতে। রাত ন’টার পর দলবেঁধে একটুখানি টিভি দেখে। এরপর রাতের খাবার শেষে ঠিক ১০টায় প্রত্যেকে ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই কাটে আশ্রমের সারাবেলা।

শুধু শুক্রবারের রুটিন একটু ব্যতিক্রম। এদিন সবাই মিলে ঘর-দোর পরিষ্কার ও বাগান পরিচর্যা করে। নিজেদের কাপড় ধোয়। মাসের শেষ শুক্রবারে আশ্রমের মেয়ে শিশুরা নিজেরা রান্না করে। এর মধ্য দিয়ে তারা রান্নার প্রশিক্ষণ নেয়। সেবাব্রতী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরিচালনা করে আশ্রমের সার্বিক কার্যক্রম। এদের মধ্যে নিত্যানন্দ, তাঁর স্ত্রী নিশা দেবী, সিন্ধু বসাক ও বিউটি দেবনাথ কাজ করেন বিনা পারিশ্রমিকে। বাকিরা নামমাত্র পারিশ্রমিক পায়।

দিনে দিনে মানব সেবার অনন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। অনাথ শিশুদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে আরও বেশকিছু সেবামূলক কার্যক্রম যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তাদের আশ্রয় কেন্দ্র, হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতি। হিন্দু-মুসলিমসহ নানা সম্প্রদায়ের পঁচিশ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নিবিড় পরিচর্যার মধ্য দিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো পার করছেন এখানকার বৃদ্ধাশ্রমে। বার্ধক্যজনিত কারণে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৪ জন। এছাড়া বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা ছয়জন আছে আশ্রয়কেন্দ্রে। আশ্রমই বহন করে এদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসার যাবতীয় খরচ। এদিকে সপ্তাহের প্রতি শনিবারে বসে ফ্রি হোমিও চিকিৎসা ক্যাম্প। প্রতিদিন আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ রোগী হয় বলে জানান হোমিও চিকিৎসক মফিজ উদ্দিন। এছাড়া প্রতি শীত মৌসুমে আশ্রমের পক্ষ থেকে এলাকার গরিবদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। রমজান মাসের নির্দিষ্ট দিনে ভিক্ষুকদের ইফতার করিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয় নতুন কাপড়। একইভাবে দুর্গাপূজাতেও গরিবদের মাঝে কাপড় বিতরণ করা হয়। জানুয়ারি মাসের একদিন দুর্গাপুর, কলমাকান্দা ও পূর্বধলা উপজেলার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে দেয়া হয় কম্বল এবং সাদাছড়ি। নিজ এলাকা ছাড়াও কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোণা প্রভৃতি এলাকায়ও গরিবদের মাঝে কম্বল ও শীতবস্ত্র বিতরণ, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা এবং সেলাইমেশিন প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। এদিকে আশ্রমের শিশুদের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো হচ্ছে পশুপালন, মৎস্যচাষ, কম্পিউটার, সবজি আবাদ, বৈদ্যুতিক কাজ, ডেকোরেশন, সাউন্ড সিস্টেম প্রভৃতি। আরও ব্যতিক্রম এবং চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে প্রতি জ্যৈষ্ঠ মাসের ১ তারিখে আশ্রমের সব বাচ্চাদের সম্মিলিত জন্মদিন পালন করা হয়। উদযাপন করা হয় বিভিন্ন পূজা-পার্বন।

মানব কল্যাণকামী অনাথালয়ে ছয় বছর বয়সে আশ্রমে এসেছিল উপজাতি পরিবারের অনাথ শিশু টুই চেননু মারমা। এখান থেকে আইএ পাস করে এখন তিনি বিজিবিতে চাকরি করছেন। পাঁচ বছর বয়সে অনাথদের তালিকায় নাম লিখিয়েছিলেন গোপাল চক্রবর্তী। বিএ পাস করে এখন চাকরি করেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে। একইভাবে পাঁচ বছর বয়সে আশ্রমে এসে এখন ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগে অনার্স পড়া শেষ করেছেন সুদীপ পাল। তার মতো আরও চারজন পড়ছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখাপড়া শেষ করে কর্মজীবনে না ফেরা পর্যন্ত অনাথালয়ের সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৪৫ জন কর্মজীবনে প্রবেশ করে আশ্রম ত্যাগ করেছে। এদের কেউ সরকারী, আবার কেউ বেসরকারী চাকরি করছে। আবার বিয়ে-থা করে সংসারীও হয়েছে কেউ কেউ। সাফল্যের বিবরণ এখানেই শেষ নয়। দুর্গাপুরে অনুষ্ঠিত যে কোন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা বা উৎসবের সেরা পুরস্কারটিও এ অনাথালয়ের শিশুরাই অর্জন করে। মানবসেবায় অবদানের জন্য এর স্বপ্নদ্রষ্টা নিত্যানন্দ গোস্বামীও পেয়েছেন বহু পুরস্কার-সম্মাননা।

এত সাফল্য সত্ত্বেও অনাথালয়টির কার্যক্রম চলছে চেয়ে-মেগে। কারণ এর নিজস্ব কোন আয়ের উৎস নেই। মাসে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয় প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু সরকারী অনুদান বলতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বছরে আসে মাত্র চার-পাঁচ লাখ টাকা। তা দিয়ে বড়জোর দু’মাস চলে। এছাড়া বিভিন্ন জেলার প্রায় ৫০ আজীবন সদস্য বিভিন্ন সময়ে সামান্য কিছু টাকা পাঠান যদিও তা দিয়ে দু-একমাসের খরচও চলে না। অপরদিকে স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মাঝে কিছু অনুদান দিলেও তা উল্লেখ করার মতো নয়। এ কারণে আশ্রমের খরচ যোগাতে নিত্যানন্দ গোস্বামীকে হিমশিম খেতে হয়েছে। হাত পাততে হয় তাঁর ভক্ত, শিষ্য-সামন্ত ও সহৃদয়বান ব্যক্তিদের কাছে। তা নাহলে সার্বিক কার্যক্রম অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই অনাথ শিশু বা অসহায় বৃদ্ধ মানুষগুলোকে তো আর না খাইয়ে রাখা যায় না!

এই বিশাল কর্মযজ্ঞ রেখে না ফেরার দেশে চলে গেলেন চণ্ডীগড় মানব কল্যাণকামী অনাথালয়ের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নিত্যানন্দ গোস্বামী নয়ন  (৬৫)।  তিনি সোমবার রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে উপজেলা সরকারী হাসপাতাল থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে নেয়ার পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে ময়মনসিংহ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই ছেলেসহ আত্মীয়-স্বজন অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।এ মানুষটি সারাজীবন অনাথ শিশুদের লালন পালনে নিজের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।

 

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।