করোনা প্রাদুর্ভাব: বাঙালির অবাধ্যতা ও আমাদের অসহায়ত্ব-মঈনউল ইসলাম

অবাধ্যতার সূত্র ধরিয়াই মানবজাতির পৃথিবীতে আগমন। সৃষ্টিকর্তা বেহেশত তৈরি করিয়া সৃষ্টি করিলেন আদম ও হাওয়াকে। তাঁহাদের স্বাধীনতা দিলেন অনিঃশেষ বেহেশতের সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইবার, সবকিছু উপভোগ করিবার; শুধু বারণ করিলেন গন্ধম ফল আহার করিতে। এই নিষেধাজ্ঞাই কাল হইয়া দাঁড়াইল। তাঁহাদের কৌতুহল বাড়িয়া গেল; নিষিদ্ধের প্রতি সহজাত আকর্ষণ তীব্রতর হইলো। নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালকে ছিন্ন করিয়া অমৃতসম(!) সেই ফল মাত্র একবারের তরে চাখিয়া দেখিবার জন্য তাঁহারা প্রতারণা করিলেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে। সেই শুরু। তখন থেকেই অনাবশ্যক কৌতুহল, প্রতারণা এবং অবাধ্যতা মানবজাতির জীবনাচরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালিদের মধ্যে ইহার মাত্রা একটু বেশি-বেশিই রহিয়া গিয়াছে বোধ করি।

উপজেলার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রশাসনিক প্রধান এবং অন্যান্য কর্মকর্তাগণ একত্রে গিয়ে একজন করোনা রোগীর (কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত) শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিয়া তাঁহাকে গৃহে অবস্থানের (হোম আইসোলেশন) পরামর্শ দিয়া আসিয়াছেন। স্বাস্থ্য বিধি ও সামাজিক রীতিনীতিকে পুস্তকের মলাটে আবদ্ধ রাখিয়া পরদিনই তিনি বাড়ির বাহিরে আসিয়াছেন। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তাঁহার ন্যায় একজন মহামহিমকে গৃহবন্দির অপচেষ্টার কারণে তিনি পরামর্শ দাতাগোষ্ঠীর সদস্যদের চতুর্দশ পুরুষের পিণ্ডি উদ্ধার করিয়াছেন। তিনবার টেস্ট করিবার পরেও কোনো রোগ না পাওয়ায় বাঙালি নিজের সু্স্থতার বিষয়ে নিশ্চিত না হইয়া বরং পরীক্ষা অথবা যন্ত্রের যথার্থতা নিয়া প্রশ্ন তুলিয়া অভ্যস্থ; সেইখানে শারীরিকভাবে সক্ষম একজন অতিশয় সাহসীকে রোগী সাব্যস্ত করিবার অপচেষ্টা নিতান্তই দুরভিসন্ধিমূলক নিশ্চয়!

মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে এই সংক্রমণের মধ্যে হোম কোয়ারান্টাইন ও নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিতকরণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখিবার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন সহকর্মীদের বাহিরে পাঠাইতে হয়, পাঠানো হয়। কী পরম আন্তরিকতায়, চাবি দেওয়া পুতুলের মতো কোনো প্রশ্ন না করিয়া তাঁহারা বাহিরে গমন এবং দায়িত্ব পালন করেন! ভীষণ অসহায় বোধ করি তাঁহাদের নিরাপত্তার উদ্বেগে। বিভিন্ন মহলের সমালোচনার ভয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংগৃহীত কিংবা কোনো বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হইতে উপহার পাওয়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ (পিপিই) পরিধান করিতেও তাঁহারা এখন শঙ্কিত বোধ করেন। অথচ ইতোমধ্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশসহ বিভিন্ন শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সংক্রমিত হইয়াছেন অনেকেই। খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন না হইলেও অনেকেই সরকারি হটলাইন নম্বরে (৩৩৩) ফোন করিয়া সরকারি কর্মচারীগণের জনমুখীতার পরীক্ষা গ্রহণ করিতেছেন। সহকর্মীদের অভিযোগ তাঁহারা ইদানিং উপহাসের পাত্র হইয়াছেন। মোবাইল কোর্ট দেখিয়া নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত ব্যবসায়ী এবং অকারণে ঘোরাফেরা করা বীরপুঙ্গবগণ সামান্য আড়ালে চলিয়া যান। মোবাইল কোর্টের প্রস্থানের পরক্ষণেই আবার তথৈবচ অবস্থা। চমৎকার লুকোচুরি খেলা। সেনাবাহিনির বেলাতেও একই। একটি গল্প এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। কোনো এক উপসনালয়ের প্রবেশমুখে একটি বিষধর সাপ বাস করিত। পুজারিগণ উপাসনালয়ে প্রবেশ করিতে গেলে সাপটি তাঁহাদের ছোঁবল মারিতে উদ্যত হইত। ভীত-সন্ত্রস্ত পুজারির সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পাইতে লাগিল। অবস্থা বেগতিক দেখিয়া পুজারিগণ সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করিল ‘হে প্রভূ! বিষাক্ত এই সর্পটির কারণে আমাদের উপাসনালয়ে গমন বিঘ্নিত হয়। আপনি ইহাকে ধ্বংস অথবা নির্বিষ করিয়া দিন’। সৃষ্টিকর্তা দেখিলেন খুবই যৌক্তিক কথা। একটি সর্পের কারণে তাঁহার পুজারির সংখ্যা হ্রাস পাইবে ইহা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। তিনি প্রার্থনা কবুল করিলেন। বিষাক্ত কালসাপকে নির্বিষ এবং ফনা তোলার ক্ষমতা রহিত করিয়া দিলেন। ভক্তগণ অতিশয় আনন্দিত হইলেন। মন্দিরে পুজারির সংখ্যা বৃদ্ধি পাইল। তাঁহারা মন্দিরে গমনাগমনের সময় অকারণে সাপটিকে চপেটাঘাত, পদাঘাত এবং উপহাসাঘাত করিতে লাগিলেন। সাপটির জীবন খুবই সংকটাপন্ন হইয়া পড়িল। নিরূপায় হইয়া সাপটি প্রার্থনা করিল ‘হে প্রভূ! আমিও আপনারই সৃষ্টি। নির্বোধ মনুষ্যকুলের যন্ত্রণায় আমার জীবনযাপন দুর্বিষহ হইয়া পড়িয়াছে। পুজারিগণের নিষ্ঠুরতা ও বিদ্রূপ খুবই কষ্টদায়ক ও অপমানজনক। আপনি আমাকে নির্বিষ করিয়াছেন ক্ষতি নেই; কিন্তু আমার ফোঁস ফোঁস করিবার ক্ষমতা ফিরাইয়া দিন। আক্রমণ করিতে আসিলে যাহাতে তাঁহাদের ভয় দেখাইয়া দূরে রাখিতে পারি’। সেনাবাহিনিও জনগণের বন্ধু হইয়া পড়িলে আমজনতার ওপর তাহাদের স্বাভাবিক প্রভাব অপসৃত হইবে যাহা ভবিষ্যতে ক্ষতির কারণ হইয়া দাঁড়াইতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হইতে সমগ্র বাংলাদেশকে অবরুদ্ধ ঘোষণা করা হইয়াছে। একইভাবে স্থানীয় প্রশাসন মানুষ ও যানবাহনের চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করিয়াছে। মহামারী আকারে ছড়াইয়া পড়া এই রোগ প্রতিরোধের অন্যতম উপায় মানুষে-মানুষে সংমিশ্রণ এড়ানো। দুঃসাহসী বাঙালি পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে, পায়ে হেটে, মাছের ড্রামের ভিতরে, ট্রাকের পিছনে ত্রিপল-আবৃত হইয়া সারাদেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছেন। কেউবা সারাদিন অকারণে বাহিরে ঘোরাঘুরি করিয়া আসিয়া বন্ধুমহলে নিজেকে জাহির করিয়াছেন ‘প্রশাসন তাঁহার টিকিও স্পর্শ করিতে পারে নাই’ হিসেবে। এ যেন এক অঘোষিত যুদ্ধ-‘বাহিরে আমি যাবই, পারলে ঠেকাও’। সংবিধান তাঁহাকে মুক্তভাবে চলাচল ও সমাবেশ করিবার অধিকার প্রদান করিয়াছে; তাহাকে রুখিবার সাধ্য কাহার? পুলিশ কিংবা মোবাইল কোর্টকে আপনি ফাঁকি দিতে সমর্থ হইয়াছেন; কিন্তু কোভিড-১৯ ভাইরাস যে আপনার সঙ্গে প্রতারণা করে নাই তাহার নিশ্চয়তা কোথায় ব্রো?

কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করিবার বাঙালি-প্রবণতার স্বরূপ অন্বেষণ করিতে গিয়া ড. আকবর আলি খান তাঁহার ‘অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ বইয়ে মেকলে’র শরণাপন্ন হইয়াছেন। মেকলে’র বর্ণনার যে বাংলা প্রতিরূপ তিনি করিয়াছেন তাহা হইলো-‘মোষের যেমন শিং আছে, মৌমাছির আছে হুল, সংগীতে যেমন মেয়েদের সৌন্দর্য, তেমনি বাঙালিদের বিশেষত্ব প্রতারণা’। কী দুঃসহ অপমানজনক! অথচ আজকের দিনের জন্যও ইহা একটি রূঢ় বাস্তবতা।

একটি বহু পুরাতন কৌতুক না বলিলেই নয়। এক গ্রামে একজন ভয়ঙ্কর দুষ্ট লোক বাস করিতেন। অন্যের অপকার, ক্ষতি বা বিরক্ত করা কিংবা অন্যকে বিপদে ফেলাই ছিলো তাঁহার সমস্ত দিনের কর্মসূচি। গ্রামের লোকেরা তাঁহার প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলো। তথাপিও অপমানিত হইবার ভয়ে কেহ তাঁহাকে কিছু বলিতো না। কালক্রমে সেই ব্যক্তি ভীষণ অসুস্থ ও প্রায় চলৎশক্তিহীন হইয়া পড়িল। তাঁহার মনে হইলো আর বেশি দিন বাঁচিবে না। সে তাঁহার যাপিত জীবনের জন্য অনুতপ্ত হইলো। তাঁহার মনে হইলো গ্রামের সকলের নিকট কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ। গ্রামের সবাইকে তাঁহার বাড়িতে আসিবার জন্য খবর পাঠাইলো। ইহা তাঁহার নতুন কোনো কারসাজি হইবে ভাবিয়া সবাই মুখ ফিরাইয়া রাখিল। এইভাবে কয়েকবার অনুরোধ করিবার পরও যখন কেউ আসিলো না তখন অনেক কষ্ট করিয়া সে গ্রামের মুরুব্বির বাড়িতে হাজির হইলো। মুরুব্বির পদযুগল ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলো ‘আমি সারাজীবন গ্রামবাসীর প্রতি অন্যায় করিয়াছি। এখন সকলের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। সকলের সামনে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করিতে চাই’। তাঁহার অনুনয় বিনয় শুনিয়া মুরুব্বি পরেরদিন সবাইকে এক স্থানে সমবেত হইতে বলিলেন। সকলের উপস্থিতিতে লোকটি বলিলো, ‘আমি সারাজীবনে যে অপরাধ করিয়াছি, আপনাদের যেরূপ কষ্ট দিয়াছি, তাহা ক্ষমার অযোগ্য। আপনারা ক্ষমা না করিলে মরিয়াও শান্তি পাইব না। আপনাদের নিকট আমি ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আমার অপরাধের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করিতে চাই। মৃত্যুর পরে আমার মৃতদেহের গো—–মধ্যে বাঁশ ঢুকাইয়া গ্রামে প্রবেশের মূল ফটকে টাঙাইয়া রাখিতে হইবে। ইহাই হইবে আমার প্রায়শ্চিত্ত’। প্রথমে রাজি না হইলেও তাঁহার নাছোড়বান্দা মনোভাবের কারণে গ্রামবাসী সম্মত হইলো। অবশেষে সৃষ্টিকর্তার আহ্বানে সাড়া দিয়া তিনি ইহধাম ত্যাগ করিলেন। মৃত্যুর পূর্বের শেষ ইচ্ছা পূরনের জন্য গ্রামবাসী একত্রিত হইয়া ঐ ব্যক্তির মৃতদেহ সৎকার না করিয়া বরং গ্রামের প্রধান ফটকে টাঙাইয়া দিলো। আপদ বিদায় হইয়াছে এবং তাঁহার শেষ ইচ্ছাও পূরণ করা গিয়াছে এমন একটি তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে সকলে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলো। কিন্তু বিধি বাম! বাতাসে ভাসিয়া খবর পৌঁছাইলো স্থানীয় থানায়। নাট্যমঞ্চে অতি দ্রুত পুলিশের আগমন ঘটিলো। মৃতদেহের প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণের অপরাধে গ্রামবাসীদের গ্রেফতার করিয়া কোর্টে চালান করা হইলো। গ্রামবাসী দীর্ঘশ্বাস ছাড়িতে লাগিলো ‘শালার কপাল! মরিয়াও ব্যাটা আমাদের শান্তিতে থাকিতে দিলো না’।

প্রজাতন্ত্রের সামান্য কর্মচারী হইয়া প্রজাতন্ত্রের মালিকের কর্ণকুহরে সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করা কি শোভনীয়? কর্মচারীর এমন ধৃষ্টতা মালিকের জন্য খুবই অপমানজনক নয় কি? কর্মচারীর বচন পালন করা মনিবের জন্য লজ্জাজনক নয় কি? তাহা হইলে কি মালিকের ইজ্জতের হানি হইবে না? অতএব, চুপ করিয়া থাকো হে সেবক! ছোট মুখে বড় কথা কখনোই কাম্য নহে। মালিককে মালিকের স্বাধীনতায় চলিতে দাও। নিজের কল্যাণার্থে নিজেই দূরে অবস্থান করো। মঈনউল ইসলাম, জেলা প্রশাসক,নেত্রকোণা।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।