কুরআন ও হাদীসের আলোকে তারাবীহ’র ফজিলত  ও তাৎপর্য: প্রেক্ষিত বর্তমান বাস্তবতা   

সালাতুত তারাবিহ  সালাতুত তারাবিহ বা তারাবীর সালাত  রমজান মাসের বিশেষ একটি ইবাদত। মাহে রমজানে রাতের বেলায় এশার ফরজ ও সুন্নত সালাতের পরে বেতরের আগে যে  সালাত আদায় করা হয় তাই মুলত সালাতুত তারাবিহ বা তারাবীর সালাত । তারাবি আরবি শব্দটি ‘তারবিহাতুন’ বা রাহাতুন  মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ ইস্তিরাহাত বা আরাম করা, বিশ্রাম নেওয়া ইত্যাদি। যেহেতু এই সালাতের  ফাকে ফাকে বিরতি দিয়ে আরামের সঙ্গে আদায় করা হয়, সে জন্য এ সালাতকে তারাবির সালাত বলা হয়।

হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি(রঃ(এর মতে তারাবীহ শব্দটি বহুবচন এক বচনে তারবিহাতুন যার অর্থ একবার বিশ্রাম গ্রহণ করা। ‘রমজান মাসে এশার নামাযের পর যে  সুন্নাত নামায পড়া হয়, তা হল তারাবীহর নামায।’  এই নামায কে ‘কিয়ামে রমজান বা কিয়ামে লাইল ও বলা হয় ।

সালাতুত তারাবীহ বা কিয়ামুল লাইলের ফজিলতঃ

 তারাবির সালাত অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। ইহা সুন্নতে মুআক্কাদাহ এর অন্তর্ভুক্ত । এই সালাত আদায় না করলে অবশ্যই বান্দাহ  গুনাহগার  হবে।  হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবিহর সালাত আদায়ের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন, এর অনেক ফজিলত বর্ণনা করেছেন। নিন্মে বিষয়ের উপর  আলোকপাত করার চেষ্ঠা করবো ইনশা আল্লাহ,

নবী করিম  ((সাঃ))বলেছেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ ইমান ও সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে রমজান মাসের রাতে কিয়ামুল লাইল  করবে অর্থাৎ তারাবির সালাত আদায় করবে,  তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। সহীহ বোখারি /১৯০১, সহিহ মুসলিম/ ৭৫৯, সুনানে দারেমি/  ১৮১৭, মুসনাদে আহমাদ/ ৯৪৪৫,

রাসুলে করিম (সাঃ) যুগে এবং হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতের প্রথম দিকে মুসলমানরা একাকী অথবা খণ্ড খণ্ড ছোট জামাতে তারাবির সালাত আদায় করতেন। অবশেষে হজরত ওমর (রা.) হজরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-কে ইমাম নির্ধারণ করে সম্মিলিতভাবে জামাতের সঙ্গে ২০ রাকাত তারাবির সালাত আদায়ের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। (সহিহ বোখারি, হাদিস : ২০১০)।

 হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ((সাঃ)) তারাবির সালাতের ব্যাপারে সাহাবিদের  উৎসাহিত করতেন কিন্তু তিনি তাঁদেরকে দৃঢ়তার সঙ্গে আদেশ করতেন না। তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে কিয়াম করবে অর্থাৎ তারাবির সালাত আদায় করবে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।সহিহ বোখারি/ ২০০৯, সহিহ মুসলিম /৭৫৯,

অন্য এক হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন , একবার রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রমজান মাসে রাতের বেলায় মসজিদে নববীতে সালাত (তারাবীহ) আদায় করলেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম ও  তাঁর সঙ্গে সালাত আদায় করলেন। একইভাবে তাঁরা দ্বিতীয় দিনেও সালাত আদায় করলেন এবং লোকসংখ্যা অনেক বেশি হলো।  এভাবে তৃতীয় দিন  এবং চতুর্থ দিনেও মানুষ একত্রিত হলো কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হুজরা থেকে বেরিয়ে তাদের নিকট এলেন না। অতঃপর সকাল হলে তিনি হুজরা থেকে বেড়িয়ে এলেন এবং বললেন, তোমাদের অপেক্ষা করার বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু শুধু এ ভয়ে আমি তোমাদের কাছে আসা থেকে বিরত থেকেছি যে, আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, না জানি তোমাদের ওপর উহা ফরজ করে দেওয়া হয়। (সহিহ বোখারি/ ৯২৪, সহিহ মুসলিম/ ৭৬১,

হযরত আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর  সঙ্গে রমজানের রোযা রাখলাম। তিনি প্রায় পুরো মাসটাই আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করেননি। শেষ পর্যন্ত যখন মাত্র সাত দিন অবশিষ্ট থাকল, তখন তিনি আমাদেরকে নিয়ে সালাতে দাঁড়ালেন (২৩তম রাত); এমনকি রাতের এক-তৃতীয়াংশ সালাতে অতিবাহিত হল। অতঃপর ২৪তম রাতে তিনি আমাদেও নিয়ে সালাতে দাঁড়ালেন না। অপর রাতে (২৫তম রাত)  তিনি আমাদেরকে নিয়ে সালাতে দাঁড়ালেন এবং অর্ধরাত অতিবাহিত হল। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি যদি এ রাতের সালাতকে আমাদের জন্য নফল করে দিতেন (তাহলে কতইনা ভাল হত!)। তিনি বললেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন ইমামের সঙ্গে সালাত শেষ করা পর্যন্ত সালাত আদায় করবে, তখন তার জন্য পুরো রাতটাই সালাত আদায় করা হিসাবে গণ্য হবে (অর্থাৎ পুরো রাত সালাত আদায়ের নেকি তার জন্য লিপিবদ্ধ করা হবে)।

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর যখন তৃতীয় রাত (২৭তম রাত) হল, তখন তিনি তার পরিবার-পরিজন, স্ত্রীগণ ও অন্যান্য লোকদের একত্রিত করে আমাদেরকে নিয়ে এত দীর্ঘ সময় সালাত আদায় করলেন যে, আমরা ‘ফালাহ’ ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা করলাম। হযরত জুবাইর বিন নুফাইর বলেন, আমি জিজ্ঞাস করলাম, ‘ফালাহ’ কি? তিনি (আবু যর রাঃ) বলরেন, সাহরি। অতঃপর মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে তিনি আমাদের নিয়ে সালাতে দাঁড়াননি। (তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ইরওয়াউল গালীল)।
রাসুলুল্লাহ ((সাঃ)) তারাবীহর নামায নিয়মিত জামাতে আদায় করেননি। কারণ তিনি কোনো আমল নিয়মিত করলে তা ফরজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর তারাবিহ সালাত ফরয হওয়ার ভয় সম্পূর্ণভাবে দূরীভূত হয়ে যায় তাই  হিজরী ১৪ সনে খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এ সুন্নাতকে পুনর্জীবিত করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, পবিত্র রমজান মাসে তারাবীহর নামাযে একবার কুরআন শরীফ খতম করা সুন্নাত। দুই বার খতম করা উত্তম। আর তিনবার খতম করা অতিউত্তম। ফাতওয়া দারুল উলুম দেওবন্দ ৪র্থ খন্ড, ২৭৪ পৃষ্ঠা)

সালাতুত তারাবীহ বা কিয়ামুল লাইলের তাৎপর্যঃ

নফল ইবাদতের শ্রেষ্ঠ সময় পবিত্র রমজান মাস । রাসূলে আকরাম (সাঃ) রমজান মাসে কিয়ামুল লাইল বা রাত্রিকালীন ইবাদতকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি অন্য যেকোনো মাসের তুলনায় এ মাসে বেশি কিয়ামুল লাইল আদায় করেছেন। কিয়ামুল লাইল আদায় করলে গুনাহ মাফের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। নিচে এর তাৎপর্য বর্ণনা করা হলোঃ-

মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘রাতে জাগরণ করো (সালাত আদায় করো)। রাতের কিছু অংশ অথবা তারচেয়ে কম অথবা তারচেয়ে  একটু বেশি’ সুরা মুজ্জাম্মিল /২,৩

হযরত আমর বিন মুররাহ আল-জুহানী হতে বর্ণিত তিনি বলেন, কুযাআ’হ গোত্রের এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি এই মর্মে সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ছাড়া (ইবাদতের উপযুক্ত) কোনো উপাস্য নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসুলুল্লাহ, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করি, রমজান মাসের ছিয়াম পালন করি, তারাবিহ অর্থাৎ  কিয়ামুল লাইল  আদায় করি ও যাকাত প্রদান করি, তাহলে আমার ব্যাপারে আপনার মতামত কি? রাসুলুল্লাহ (সাঃ)বললেন,যে “ব্যক্তি এর উপর মৃত্যুবরণ করবে সে সত্যবাদী ও শহীদদের মধ্যে গণ্য হবে”। ইবনে খুযায়মা, ইবনে হিব্বান, তারগীব

নফসের কুপ্রভাব, প্রতারণা ও ধোঁকা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এবং নফসের উন্নতি সাধনে এই সালাতের কার্যকারিতা অতুলনীয়। ইরশাদ হচ্ছে : ‘নিশ্চয় ইবাদতের জন্য রাত্রিতে উঠা প্রবৃত্তি দমনে  সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল’। (সূরা মুজাম্মিল : আয়াত : ৬)

রাসূল (সাঃ) বলেনঃ- ‘কেউ রমজানে একটি নফল আদায় করলে অন্য সময়ের ফরজ আদায়ের সওয়াব পাবে। আর ফরজ আদায় করলে অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান হবে।’ (শুআবুল ঈমান/ ৩৩৩৬)

জামাআতের সহিত তারাবিহ বা কিয়ামুল লাইল ও বর্তমান বাস্তবতাঃ

ফরয সালাত ব্যতিত অন্য সকল সালাত একাকী আদায় করা উত্তম। কিন্তু তারাবিহ সালাত ব্যতিক্রম। তারাবিহ সালাত জামাআতের সহিত আদায় করা শরীয়ত সম্মত। বরং তারাবিহ একাকী আদায় করার চেয়ে জামাআত বদ্ধভাবে আদায় করা উত্তম। কারণ, (সাঃ) নিজে তারাবিহ’র জামাআ’ত করেছেন ।পুর্বেই উল্ল্যেখ করা হয়েছে, হযরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত , তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সঙ্গে রমজানের রোযা রাখলাম। তিনি প্রায় পুরো মাসটাই আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করেননি। শেষ পর্যন্ত যখন মাত্র সাত দিন অবশিষ্ট থাকল, তখন তিনি আমাদেরকে নিয়ে সালাতে দাঁড়ালেন (২৩তম রাত); এমনকি রাতের এক-তৃতীয়াংশ সালাতে অতিবাহিত হল। অতঃপর চতুর্থ রাতে তিনি আমাদেও নিয়ে সালাতে দাঁড়ালেন না। অপর পঞ্চম রাতে তিনি আমাদেরকে নিয়ে সালাতে দাঁড়ালেন (২৫তম রাত) এবং অর্ধরাত অতিবাহিত হল। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুলুল্লাহ! আপনি যদি এ রাতের সালাতকে আমাদের জন্য নফল করে দিতেন (তাহলে কতইনা ভাল হত!)। তিনি বললেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন ইমামের সঙ্গে সালাত শেষ করা পর্যন্ত সালাত আদায় করবে, তখন তার জন্য পুরো রাতটাই সালাত আদায় করা হিসাবে গণ্য হবে (অর্থাৎ পুরো রাত সালাত আদায়ের নেকি তার জন্য লিপিবদ্ধ করা হবে)। আবার যখন তৃতীয় রাত হল, তিনি সালাত আদায় করলেন না। অতঃপর যখন চতুর্থ রাত (২৭তম রাত) হল, তখন তিনি তার পরিবার-পরিজন, স্ত্রীগণ ও অন্যান্য লোকদের একত্রিত করে আমাদেরকে নিয়ে এত দীর্ঘ সময় সালাত আদায় করলেন যে, আমরা ‘ফালাহ’ ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা করলাম। হযরত জুবাইর বিন নুফাইর বলেন, আমি জিজ্ঞাস করলাম, ‘ফালাহ’ কি? তিনি (আবু যর) বলরেন, সাহরি। অপর মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে তিনি আমাদের নিয়ে সালাতে দাঁড়াননি। (তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ)।
ফুকাহায়ে কেরাম বলেন: পুরুষের মসজিদে জামাতের সাথে তারাবীহর নামায পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কেফায়া। কোন মহল্লায় যদি কেউ-ই জামাতের সাথে না পড়ে তাহলে সকলেই গুনাগার হবে । আর যদি কিছু লোক মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করে আর কেউ কেউ ঘরে একা একা আদায় করে তাহলে সকলেই  গুনাহ থেকে মুক্ত থাকবে। তবে একথা অবশ্যই স্বরণ রাখতে হবে যে, যারা একা একা পড়ল তারা জামাতে পড়ার সওয়াব থেকে বঞ্চিত হল। কামুসুল ফিকহ ২য় খন্ড পৃঃ ৪৫০  ।

এখন বর্তমান বাস্তবতার আলোকে পাঠক সমীপে  দু একটি কথা বলার চেষ্টা করবো ইনশা আল্লাহ।

 দুনিয়ার কল্যান ও আখিরাতে মুক্তির একমাত্র পথই ইসলাম । আর ইসলামের প্রথম রুকন  হলো সালাত । ইসলামে জামাতে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে জোর তাকিদ থাকলেও সুন্নাত ও নফল নামাজ নিজ নিজ গৃহে আদায়ের ও গুরুত্বপুর্ণ ফজিলত রয়েছে।  হযরত জাবের (রাঃ) এর বরাত দিয়ে এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন তোমাদের কেউ যখন মসজিদে (ফরজ) নামাজ সম্পন্ন করে তখন তার উচিৎ সে যেন তার নামাজের কিছু অংশ ( সুন্নাত নামাজ) নিজের বাড়ির জন্য রাখে। কারন বাড়ীতে আদায় করা কিছু নামাজের মধ্যে আল্লাহ তাআলা কল্যান নিহিত রেখেছেন। ( ছহিহ মুসলিম)

হয়রত যায়েদ বিন সাবেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন,হে, মানব মন্ডলী! তোমরা নিজ ঘরে (সুন্নাত ও নফল) নামাজ আদায় কর। (নাসাঈ ইবনে খুজাইমা, তাগরীব)।

হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থদ্বয় বায়হাকি ও তাগরীবের বর্ণনা অনুযায়ী একথা স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, ফরজ নামাজ ছাড়া অন্য সুন্নাত ও নফল নামাজ নিজ গৃহে লোক চক্ষুর অন্তরালে আদায় করাই উত্তম । এমন কি ক্ষেত্র বিশেষ এর ফজিলত বহুগুন বেশী।

হয়রত আব্দুল্লাহ  ইবনে  উমর  (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওইয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,হে, মানব মন্ডলী! তোমরা নিজ ঘরে নামাজ কিছু অংশ আদায় কর। আর ঘর গুলোকে কবরস্থানে পরিনিত করোনা (সহিহ বোখারি/ ৪২২, সহিহ মুসলিম/ ৭৭৭,

 ফজিলত ও অবস্থা বিবেচনায় মুসলিম উম্মাহর উচিৎ ফরজ নামাজ ছাড়া অন্য সুন্নাত ও নফল নামাজ নিজ গৃহে লোক চক্ষুর অন্তরালে আদায় করা, কেননা যে ঘরে নফল ইবাদত যেমন নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি আদায় করা হয় সে ঘরে আল্লাহর রহমতের ফেরেস্তারা আসা যাওয়া করে।  আল্লামা নাওয়ারি (র) বলেন, নফল নামাজ মসজিদে আদায় করা থেকে ঘরে আদায় করা উত্তম এমনকি তা মসজিদে হারাম হলেও।-ফয়জুল কাদির ১/৪১৮

আল্লামা ইবনে কুদামা  (র) বলেন, নফল নামাজ ঘরে আদায় করা উত্তম কারন এতে ইখলাস বা একনিষ্ঠতা উত্তমরুপে হাসিল হয়। রিয়া বা অহংকার থেকে পরিত্রাণ লাভ করা যায়। আল মুগনি ১/৪৪২

এখন জেনে নেই  মহামারি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় মুহুর্তে তারাবীহ  নামাজে অংশ গ্রহন সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা কি?

ইরশাদ হচ্ছে  আল্লাহ তায়ালা কারো ওপর তার ক্ষমতার বাইরে দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। সুরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ২৮৬)।  অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-আল্লাহ তায়ালা চান তোমাদের বোঝা হালকা করে দিতে। সুরাঃনিসা, আয়াতঃ ২৭) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে- অতএব তোমরা আল্লাহ কে ভয় কর যতটা সম্ভব” সুরা তাগাবুন/১৬

আগেই বলা হয়েছে ফরয সালাত ব্যতিত অন্য সকল সালাত একাকী আদায় করা উত্তম। তারাবিহ সালাত জামাআতের সহিত আদায় করা শরীয়ত সম্মত। বরং তারাবিহ একাকী আদায় করার চেয়ে জামাআত বদ্ধভাবে আদায় করা উত্তম এবং নিঃসিন্ধেহে অত্যন্ত নেকির কাজ। কিন্তু বর্তমানে করোনা ভাইরাস বা কোভিট/১৯ মহামারির রুপ ধারন করেছে  এই সময়ে  যেহেতু একে অন্যের থেকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাই  ইসলামের বিধান কি হবে? মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে কারীমের ইরশাদ করেন “তোমরা নিজেদেরকে ধবংসের দিকে ঠেলে দিও না”(সুরা ব্বাকারা ১৯৫)  অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে অপরাধ ছাড়া  মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দাতারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে। সুরা  আহজাব, আয়াতঃ ৫৮।

  জ্ঞানীরা বলেন, “দেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ” যেহেতু  মহামারি করোনাভাইরাস বা কোভিট /১৯ এর প্রকোপে  বিশ্বব্যাপী অসংখ্য লোক মারা যাচ্ছে । এই প্রেক্ষিতে গণজামায়েত কে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপি  মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে । সংকট থেকে উত্তোরনের জন্য সরকার ও তার অঙ্গ প্রতিষ্ঠান গুলো রাত দিন নিরলস প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে । গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সব দিক থেকে সহযোগীতা করার জন্য নিরলস প্রচেষ্ঠা করে যাচ্ছেন, বারবার নাগরিকদের ঘরে অবস্থান ও গনজামায়েত এড়িয়ে চলার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের বৈধ আদেশ মেনে চলা আমাদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। ক্ষেত্র বিশেষ ফরজও বটে। রাসুলে কারীম (সাঃ) বলেন- তোমরা মহান আল্লাহর  ও তার রাসুলুল্লাহর আনুগত্য করার সাথে সাথে ‘উ’লিল আমর’ তথা দায়িত্বশীল ব্যাক্তির আনুগত্য করবে । অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যদি হাবসি কৃতদাসকেও আমীর বা নেতা নির্বাচিত করা হয় তাকেও মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। এই হাদীসদ্বইয়ে নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের কি কর্তব্য তা প্রকাশ পেয়েছে । রাষ্ট্রের বৈধ নির্দেশনা এড়িয়ে চলা এক ধরনের বিশৃংখ্যলার শামিল। আর ইসলাম বিশৃংখলা সৃষ্টিকারি কে পছন্দ করে না । ইরশাদ হচ্ছে, তোমরা সমাজে ফাসাদ (বিশৃংখ্যলা ) সৃষ্টি করোনা আল্লাহ ফাসাদ সৃষ্টি কারী কে পছন্দ করেন না। সুরা ক্বাসাস/৭৬ অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, “ফিৎনা হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ” সুরা বাক্বারা আয়াত২১৭

ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা অমান্য করে মসজিদ বা অন্য যে কোন স্থানে গণজামায়েতের কারনে নিজে অথবা অন্য কেউ সংক্রামিত হয়ে যদি নিহত হয় তবে সংক্রামন বহন কারি ব্যাক্তি হত্যার অপরাধে অভিযোক্ত হবে।  ইরশাদ হচ্ছে ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধবংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযোক্ত ব্যাক্তি ছাড়া (অন্য কোন নিরপরাধ ) ব্যাক্তিকে যদি কেউ হত্যা করে সে যেন পুরা মানব জাতিকেই হত্যা করলো। সুরা মায়িদা /৩২

আমরা সবাই জানি, করোনা ভাইরাস বা কোভিট/১৯  ছোঁয়াচে হওয়ায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার সমুহ সম্ভাবনা থাকে যা শুধু নিজেকে নয় পুরা মানব জাতিকেই ধংস করার শামিল । যা গুনাহে কাবীরার অন্ত্ররভুক্ত। এই সময়ে শুধুমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে দলেদলে সালাতে তারাবীহ সহ যে কোন গাণজমায়েতে অংশগ্রহণ করা বা যে কোন ধর্মীয় বা সামাজিক জামায়েতের আয়োজন করা  শুধু নির্বোধের পরিচয়ই নয় বরং ধর্মের নামে অধর্ম ও বটে। এ ক্ষেত্রে আবেগ নয় সঠিক ধর্মীয় ও রাষ্ট্রিয় নির্দেশনা মুতাবেক বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে আরো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন বলে আম বিশ্বাস করি। কারন মানব কল্যানমুখী জীবন ব্যাবস্থার নাম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণীত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন,এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার ভাইয়ের উপর জুলুম করবে না , তাকে বিপদে ফেলবে না , যে ব্যাক্তি তার ভাইকে  সহযোগীতা করবে,মহান আল্লাহ তাআলা নিজে তাকে সহযোগীতা করবেন। যে ব্যাক্তি কোন মুসলমানের একটি বিপদ দূর করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার বিপদ সমূহ দূর করে দেবেন করে দেবেন । যে ব্যাক্তি কোন মুসলমানের দোষত্রুটি গোপন  করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দূষত্রুটি গোপন করে দেবেন । সহিহ বুখারীঃ হাদিস নং ২৪৪২

রাসুলে কারীম(সাঃ)  সাহাবায়ে কিরাম কে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন “ মনে রাখবা তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল , আর সকলেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হইবে”সহিহ বুখারীঃ হাদিস নং ২৪৪২

একজন দায়িত্ব শীল মুসলমান হিসাবে প্রত্যেক কে স্বীয় দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে জানতে ও মানতে হবে। মানবতার কল্যানই একজন মুসলমানেরপধান দায়িত্ব।  ইরশাদ হচ্ছে “ হে মুসলমান গন তোমরাই হলে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। গোটা মানবজাতির  কল্যানের জন্যই তোমাদেকে প্রেরণ করা হয়েছে”। সুরা আলে ইমরান আয়াত ১০৯

 সুতরাং  এ কথা স্পস্ট ভাবে প্রতিয়মান হয় যে একজন মুসলিম হিসাবে আমাদের দায়িত্ব শুধুমাত্র  মুসলমানের কল্যান ই  নয় গোটা মানবতার কল্যানে কাজ করে যাওয়া । আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সমস্ত বিশ্বের সমস্ত প্রাণীকুলের জন্য রহমত হিসাবে প্রেরণ করেছেন।  এরশাদ হচ্ছেঃ “আমি আপনাকে পুরা পৃথিবীর জন্য রহমত হিসাবে প্রেরণ করেছি”। সুরা আম্বিয় আয়াত :১০৭

জনহিতকর কর্মকান্ডের ফলে একদিকে যেমন দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় অন্যদিকে আখেরাতে মুক্তির পথ ও সুগম হয় । জনৈক ব্যাক্তি রাস্তার মধ্যে পতিত একটি গাছ কেটে দেওয়ার কারনে বেহেস্তে প্রবেশ করেছিলো । (ছহিহ মুসলিম ৪/২০২১ )

তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে মহামারি করোনা ভাইরাসের এই সময়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য সময় ও শ্রম ব্যয় করি । নিন্মোক্ত কর্মকান্ডের মাধ্যমে পরিবারের  হক্ক আদায় করি।

· ঘরেই পরিবারের সদস্যদের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সহ তারাবীহ’র সালাত  আদায় করি। সালাতের বিভিন্ন আহকাম আরকান শিক্ষা দান করি ।

  • বেশি বেশি যিকির করি । সময় করে পরিবারের সদস্যদের মাসনুন জিকিরগুলো শিক্ষা দিই।
  • কুরআন তিলাওয়াত করি, সময় করে পরিবারের সদস্যদের কুরআন শিক্ষা দিই।
  • বেশি বেশি ধর্মীয় গ্রন্থাবলী পাঠ করি।
  • সম্ভব হলে ফোনে নিকট আত্বীয় স্বজনদের খুজ খবর নিই।আত্বীয়তার হক্ক আদায় করি
  • পরিবারের বয়ষ্কদের বিশেষ করে পিতামাতার যত্ন নিই । যে কোন ব্যাস্ত মানুষের পক্ষে পিতামাতার সেবা করার জন্য এটা একটা বিশেষ সুযোগ।

পরিশেষে । এই রমজানে নিজেদের ভুল স্বীকার করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে বেশী বেশী ফরিয়াদ করি তিনি যেন বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ সহ সমগ্র মানব জাতি কে এই জীবন বিনাশি মহামারি থেকে হেফাজত করেন।

আল্লাহ আমাদের ছহিহ বুঝ দান করুন। ইয়া আল্লাহ! আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশ সহ সারা জাহানের মানবকুল কে মহামারি থেকে হেফাজত কর ।আমিন ইয়া রাব্বাল আলামিন।

মোঃ শহিদুল ইসলাম শাহিন

লেখক, গবেষক, ( পি এইচ ডি ফেলো )

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া,

সহকারি শিক্ষক, নেত্রকোনা সরকারি বালকা উচ্চ বিদ্যালয়, নেত্রকোনা।

০১৭১৮০৪২১২১

 

 

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।