জানাজার নামাজ ও দাফন-কাফনে অংশ গ্রহণ করার ফজিলত ও গুরুত্বঃ প্রেক্ষিত বর্তমান বাস্তবতা।

সুপ্রিয় সুধী আসসালামু আলাইকুম আশাকরি আল্লাহর রহমতে ভালই আছেন। আজকের লিখা একটা  গল্প দিয়ে শুরু করা যাক- এক শিশু শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের  কাছে শুনেছে যে পাগড়ী পড়ে নামাজ আদায় করা অত্যন্ত ফজিলতের কাজ।   নামাজের সময়  তার কাছে কোন পাগড়ী না থাকায়  পড়নের লুঙিটা খুলে পাগড়ির মাথায় পড়ে ফজিলত টা আদায় করে নিলো।  ছোট অবুঝ শিশু বুঝতেও পারলো না যে নফল আদায় করতে গিয়ে সে ফরজ তরক করে ফেলেছে । শিক্ষক তাকে বললেন তুমি তো নফল আদায় করতে গিয়ে ফরজ তরক করে ফেলেছ।  আজ জানাজার নামাজ ও দাফন-কাফনে অংশ গ্রহণ করার ফজিলত ও গুরুত্বঃ প্রেক্ষিত বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে দু একটি কথা বলার চেষ্ঠা করবো ইনশাআল্লাহ ।

জানাযার নামাজে অংশগ্রহন  করার ফজিলত: জানাযার নামাজে অংশগ্রহন ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুন এর অংশ এবং এক প্রতিবেশীর প্রতি অন্য প্রতিবেশীর অন্যতম ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব । মৃত মানুষকে সম্মানের সহিত সমাহিত করা তার জানাজায় অংশ নেওয়া ফরজে কিফায়া। এবং একটি বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি । জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ মাত্রই এ কথা অকপটে স্বীকার করবে  এরচেয়ে সুশৃংখ্যল বিজ্ঞান সম্মত বিধান আর নেই।  ইসলামে এর ফজিলত ও অনেক। এ প্রসঙ্গে রাসুলে কারিম (সা) ইরশাদ করেন-

عَن أَبِي هُرَيرَةَ رضي الله عنه، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: « مَنْ شَهِدَ الجَنَازَةَ حَتَّى يُصَلَّى عَلَيْهَا، فَلَهُ قِيراطٌ، وَمَنْ شَهِدَهَا حَتَّى تُدْفَنَ، فَلَهُ قِيرَاطَانِ » قِيلَ: وَمَا القِيرَاطانِ ؟ قَالَ: « مِثْلُ الجَبَلَيْنِ العَظِيمَيْنِ ». متفقٌ عَلَيْهِ

 অর্থাৎঃ হয়রত আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত , রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নামায পড়া পর্যন্ত জানাযায় উপস্থিত থাকবে, তার জন্য এক ক্বীরাত্ব সওয়াব রয়েছে। আর যে ব্যক্তি দাফন করা পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে, তার জন্য দুই ক্বীরাত সওয়াব রয়েছে।’’ জিজ্ঞাসা করা হল, দুই ক্বীরাতের পরিমাণ কতটুকু?’ তিনি বললেন, দুই বড় পাহাড়ের সমান।’’ বুখারি ৪৭, ১৩২৪, ১৩২৫, মুসলিম ৯৪৫, তিরমিযি ১০৪০, নাসায়ি ১৯৯৪, থেকে ১৯৯৭, ৫০৩২, আবু দাউদ ৩১৬৮, ইবন মাজাহ ১৫৩৯,

 আম্মাজান  হযরত আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত

عَن عَائِشَة رَضِيَ اللهُ عَنهَا، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: مَا مِنْ مَيتٍ يُصَلِّي عَلَيْهِ أُمَّةٌ مِنَ المُسْلِمِينَ يَبْلُغُونَ مِئَةً كُلُّهُمْ يَشْفَعُونَ لَهُ إِلاَّ شُفِّعُوا فِيهِ ». رواه مسلم

 অর্থাৎ হযরত আয়িশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন , যে মৃতের জানাযার নামায একটি বড় জামাআত পড়ে, যারা সংখ্যায় একশ’ জন পৌঁছে এবং সকলেই তার ক্ষমার জন্য সুপারিশ করে, তার ব্যাপারে তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হয়।’’মুসলিম ৯৪৭, তিরমিযি ১০২৯, নাসায়ি ১৯৯১,

জানাজার নামাজের শর’ঈ গুরুত্বঃ-  পূর্বেই বলা হয়েছে  ইসলামী শরিয়তে জানাজা, কাফন-দাফন ইত্যাদি জীবিত মুসলমানদের ওপর মৃতদের অধিকার এবং অবশ্য পালনীয় ফরজ নির্দেশ। কোনো মুসলমান মারা গেলে তার জানাজার নামাজ আদায় করা ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ কিছুসংখ্যক মুসলমান এ দায়িত্ব পালন করলে অন্যরা দায়িত্বমুক্ত হবে; যদিও এলাকার সব লোক ও আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব (সুন্নাত) হচ্ছে মৃতের জানাজা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা এবং তার স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়া। সিহাহ সিত্তাসহ বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থের উদৃতি দিয়ে পূর্বে উল্ল্যেখ করা হয়েছে যে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ আদায় করে, সে এক ‘কিরাত’ পরিমাণ নেকি লাভ করে আর যে ব্যক্তি কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ আদায় করে এবং তার দাফনের কাজে অংশগ্রহণ করে, সে দুই ‘কিরাত’ পরিমাণ সওয়াব লাভ করে।” কোনো এক সাহাবি প্রশ্ন করলেন , ‘হে আল্লাহর রাসুল! দুই কিরাত কী?’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘দুই কিরাতের ক্ষুদ্রতম কিরাত ওহুদ পাহাড়ের সমান।’ (ইবনে কাছির)

হজরত উসমান (রা.) বর্ণনা করেন, “নবী করিম (সা.) যখন কোনো মৃত ব্যক্তির দাফনকাজ শেষ করতেন তখন তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সাহাবিদের বলতেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করো, তিনি যেন তাকে ইমানের ওপর দৃঢ় ও অবিচল রাখেন। এখনই তার কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’” (আবু দাউদ / ৩২২১)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “একজন মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের ছয়টি অধিকার রয়েছে। এক. যখন কোনো মুসলমানের সঙ্গে দেখা হয় তখন সালাম দেবে। দুই. কোনো মুসলমান ডাকলে সাড়া দেবে। তিন. সে তোমার কাছে সৎ পরামর্শ চাইলে তুমি তাকে সৎ পরামর্শ দেবে। চার. কোনো মুসলমানের হাঁচি এলে হাঁচিদাতা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলবে। পাঁচ. কোনো মুসলমান অসুস্থ হলে তার সেবা-শুশ্রূষা করবে। ছয়. কোনো মুসলমান মৃত্যুবরণ করলে তার জানাজায় শরিক হবে।” (মুসলিম/২১৬২)।

এখন জেনে নেই  মহামারি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় মুহুর্তে জানাজার নামাজে অংশ গ্রহন সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা কি?

ইরশাদ হচ্ছে  ‘আল্লাহ তায়ালা কারো ওপর তার ক্ষমতার বাইরে দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২৮৬)।  অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে- ‘আল্লাহ তায়ালা চান তোমাদের বোঝা হালকা করে দিতে এবং মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ২৭)।

সাধারণত কোনো মুসলমান মারা গেলে অন্য মুসলমানদের  ওপর ওই মৃত ব্যক্তির গোসল, জানাজা ও দাফন করা ফরজে কেফায়া।ঐ এলাকার কিছু সংখ্যক মানুষ যদি মৃতব্যাক্তির দাফন কাফন ও জানাজার ব্যাবস্থা করে তাহলে অন্য সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে অন্যতায় ঐ এলাকার সকলেই গুনাহগার হবে। হাদিসে নবুবীর আলোকে পূর্বেই উল্ল্যেখ করা হয়েছে জানাজায় অংশগ্রহণ নিঃসিন্ধেহে অত্যন্ত নেকির  কাজ  কিন্তু বর্তমান মহামারির এই সময়ে  যেহেতু একে অন্যের থেকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা সামাজিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত তাই  ইসলামের বিধান কী হবে? ইরশাদ হচ্ছেঃ “তোমরা নিজেদেরকে ধবংসের দিকে ঠেলে দিও না”(সুরা ব্বাকারা ১৯৫)    অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে -‘যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সূরা: আহজাব, আয়াত: ৫৮)।

বর্তমান সময়ে মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য লোক মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়তই। এর ই প্রেক্ষিতে গণজামায়েত কে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সৌদি আরব সহ বিশ্বমুসলিম স্কলার / মুফতিগন মসজিদে নামাজ পড়ার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও এ বিষয়ে   কঠোর অবস্থানে রয়েছে । আর নাগরিক হিসাবে আমাদের কর্তব্য হলো রাষ্ট্রের বৈধ আদেশ মেনে চলা আমাদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ক্ষেত্র বিশেষ ফরজও বটে। রাসুলে কারীম (সাঃ) বলেন- তোমরা  মহান আল্লাহর  ও তার রাসুলর অনুগত্য করার সাথে সাথে ‘উ’লিল আমর’ তথা দায়িত্বশীল ব্যাক্তির অনুগত্য করবে । অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যদি হাবসি কৃতদাসকেও আমীর বা নেতা নির্বাচিত করা হয় তাকেও মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। দেখুন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে হওয়ায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার সমুহ সম্ভাবনা থাকে যা শুধু নিজেকে নয় পুরা মানব জাতিকেই ধংস করার শামিল। যা গুনাহে কাবীরার অন্ত্ররভুক্ত। এই সময়ে শুধুমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে দলেদলে জানাজায় অংশগ্রহণ করা বা যে কোন ধর্মীয় বা সামাজিক জামায়েত ঐ শিশু শিক্ষার্থীর মতোই নির্বোধের পরিচয় যে কিনা ফরজ বাদ দিয়ে নফল আদায়ে ব্যাস্ত হয়ে পরেছিলো। এ ক্ষেত্রে আবেগ নয় বরংবিবেকের কষ্ঠিপাথরে যাচাই করে বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে আরো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন বলে আম বিশ্বাস করি। এবং জনকল্যানে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নির্দেশনা মেনে চলার ক্ষেত্রে আরো দায়িত্বশীল হবো বলে মনে করি।

রাসুলে কারীম  সাহাবায়ে কিরাম কে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন “ মনে রাখবা তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল , আর সকলকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হইবে”ছহিহ বুখারী /৭১৩৮

একজন দায়িত্ব শীল মুসলমান হিসাবে প্রত্যেক কে স্বীয় দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে জানতে হবে। একজন মুসলমানের প্রধান কাজই হলো নিজেকে সমাজ কল্যানে উৎসর্গ করা।

 ইরশাদ হচ্ছে “ তোমরাই হলে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত গোটা মানবজাতির  কল্যানের জন্যই তোমাদেকে প্রেরণ করা হয়েছে”। সুরা আলে ইমরান আয়াত ১০৯

 অত্র আয়াতের আলোকে এ কথা স্পস্ট ভাবে প্রতিয়মান হয় যে একজন মুসলিম হিসাবে আমাদের দায়িত্ব শুধুমাত্র  মুসলমানের কল্যানে নয় গোটা মানবতার কল্যানে কাজ করে যাওয়া। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শুধু মুসলমানদের জন্য  নয় বরং সমস্ত বিশ্বের সমস্ত প্রাণীকুলের জন্য রহমত হিসাবে প্রেরণ করেছেন।

এরশাদ হচ্ছেঃ “আমি আপনাকে পুরা পৃথিবীর জন্য রহমত  হিসাবে প্রেরণ করেছি”। সুরা আম্বিয় আয়াত :১০৭

জনহিতকর কর্মকান্ডের ফলে একদিকে যেমন দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় অন্যদিকে আখেরাতে মুক্তির পথ ও সুগম হয় । জনৈক ব্যাক্তি রাস্তার মধ্যে পতিত একটি গাছ কেটে দেওয়ার কারনে বেহেস্তে প্রবেশ করেছিলো । (দ্রঃ ছহিহ মুসলিম ৪/২০২১ )

তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে মহামারি করোনাভাইরাসের এই সময়ে  যে কোন গনজামায়েত থেকে বিরত থাকি এবং জাতির এই দুঃসময়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যানে সাধ্যমত অবদান রাখি।

 আল্লাহ আমাদের ছহিহ বুঝ দান করুন। আমিন ইয়া রাব্বাল আলামিন।

মোঃ শহিদুল ইসলাম শাহিন,লেখক, গবেষক, পি এইচ ডি ফেলো,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া, সহকারি শিক্ষক, নেত্রকোনা সরকারি বালকা উচ্চ বিদ্যালয়, নেত্রকোনা।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।