হাওরাঞ্চলে আফালের তান্ডবে ভাঙছে গ্রাম

বিশেষ প্রতিনিধি: নেত্রকোণার খালিয়াজুরীসহ বিভিন্ন হাওরাঞ্চলে আফালের (ঢেউ) তান্ডবে বেশীরভাগ গ্রামে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গণ কবলিত এলাকার লোকজন পরিবার পরিজন নিয়ে এক ধরণের আতংকের মধ্যে বসবাস করছেন।
বর্ষাকালে হাওরে ঝড়ো বাতাসে যে বড় বড় ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় স্থানীয় লোকজন তাকে আফাল বলে। প্রতি বছর বর্ষা মওসুমে পানি বাড়ার সাথে সাথে ঝড়ো হওয়া বাড়তে থাকে। বাতাস যত বাড়ে আফালের তান্ডবলীলা তত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। তাই বর্ষা মওসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে হাওরবাসীর মাঝে আফাল আতংক দেখা দিতে শুরু করে। ৩/৪ ফুট উচু উচু এক একটি ঢেউ আছড়ে পিেড় গ্রামগুলোতে। হাওর অধ্যূষিত গ্রামগুলোতে প্রতি বছর আফালের তান্ডবে নৌকা ডুবি, ভাড়ীঘর ও রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যায়। আফালের তান্ডবে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে খালিয়াজুরী উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। বিলীন হয়ে যাওয়া গ্রামগুলো হচ্ছে জগদীশপুর, মাগনপুর, বিক্রমপুর, কানাইনগর,সুলতানপুর, আমীনপুর, খুরশীগঞ্জ, কালিপুর, হ্যামনগর, আছানপুর, নূরপুর, কাছারীবাড়ী, হাবিবপুর,দূর্গাবাড়ী, নগর, শিবপুর, কামারবাড়ী, নরসিংহপুর, নয়ানগর, সওতাল গ্রাম। প্রাচীন মানচিত্রে ও ভূমি রেকর্ডে এ গ্রামগুলো উল্লেখ থাকলেও এগুলো এখন শুধুই হাওর।
হাওরের বুক ছিড়ে ২৪ ঘন্টাই বড় বড় কার্গো, লঞ্চ, ট্রলার চলাচল করায় এগুলোর সৃষ্ট ঢেউ, আফালের তান্ডব এবং ধনু নদীর তীব্র ¯্রােতে প্রতিনিয়ত গ্রাম, হাটবাজার গুলো ভাংছে। খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের বেশ কয়েকটি সরকারী ভবন আফালের শিকার হয়ে যে কোন সময় হাওরের পানিতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। আফাল মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় জগন্নাথপুর, রসুলপুর, লক্ষীপুর, মুজিব নগর, বল্লভপুর, পাঁচহাট চরপাড়াসহ বিভিন্ন গ্রাম নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশংকা করছে এলাকাবাসী।
বর্তমানে হাওরবাসী আফালের তান্ডব থেকে তাদের বাড়ীঘর ও রাস্তাঘাট রক্ষার জন্য ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার অনুরোধ জানালেও সংশ্লষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। তাই গ্রামবাসী বাধ্য হয়ে বাড়ীঘরের চারপাশে খড়, কচুরীপানা, ধারি ও বাঁশের খুটি ঘেড়ে এক ধরণের প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে বাড়ীঘর রক্ষার চেষ্টা চালায়। সবচেয়ে বেশী ভাঙ্গণের মুখে পড়েছে গাজীপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের শতাধিক পরিবার।
গাজীপুর পাচঁহাট গ্রামের আবুল হাসেম বলেন, হাওরে ঢেউ শুরু হলে রাতে সন্তানদের নিয়ে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। আতংকে থাকি কখন কি হয়।
বল্লভপুর গ্রামের সঞ্জিত তালুকদার বলেন, হাওরাঞ্চলে পানি সহিষ্ণু হিজল, করচ ও চাইল্যা বন আশংকাজনক হারে কমে যাওয়ায় প্রতি বছরই আফালের তান্ডবে বাড়ীঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে।
জগন্নাথপুর গ্রামের জামাল উদ্দিন বলেন, আফালের তান্ডবে গ্রামগুলো ভেঙ্গে গেলেও ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানগন ও উপজেলা প্রশাসন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
নেত্রকোণা কৃষক সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আনিছুর রহমান বলেন, হাওরবাসীর দুঃখ কেউ বুঝতে চায় না। নির্বাচন এলে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও এমপি প্রার্থীরা আফালের তান্ডব থেকে বাড়ীঘর রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও নির্বাচিত হওয়ার পর তারা আর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেন না।
খালিয়াজুরীর সন্তান রাজনীতিবিদ এডভোকেট মাসুদ রানা চৌধুরী বলেন, হাওরবাসীর দুঃখ দুর্দশা লাঘবে নদী খননসহ গ্রামগুলো রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করতে হবে।
খালিয়াজুরী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কিবরিয়া জব্বার বলেন, সর্বনাশা আফালের তান্ডব থেকে গ্রামগুলো রক্ষার জন্য গ্রামগুলোর সামনে ব্যপক হারে হিজল, করচ, ঢোল কলমি, ধৈঞ্চা জাতীয় পানি সহিষ্ণু ঢেউ প্রতিরোধক গাছ লাগাতে হবে এবং সরকারী উদ্যোগে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, সরকারী ও বেসরকারী ভাবে হাওরাঞ্চালের কিছু কিছু এলাকায় গ্রাম ও হাটবাজারের চারপাশে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ সব গ্রামে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা হবে। সেই সাথে ধনু নদী খননের জন্য প্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরী করে মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।