
বিশেষ প্রতিনিধি: বীর মুক্তিযুদ্ধা গোলজার হোসেন তালুকদার আর নেই। তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় শেষ নিশ্বাঃস ত্যাগ করেন । ইন্নালিল্লিহি– রাজিউন।
বীর মুক্তিযুদ্ধা গোলজার হোসেন তালুকদার ১৯৬১ সালে আইয়ুব মার্শাল ল বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে পদার্পণ করেন, মরহুম আব্দুল খালেক সাহেবের হাত ধরে। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেন।বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশে,শেখ ফজলুল হক মণি,সিরাজুল আলম খান,আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্রলীগের গোপন বিপ্লবী শাখা ‘নিউক্লিয়াসের’ সক্রিয় সদস্য হিসাবে সকল কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচি প্রচার করেন বৃহত্তর ময়মনসিংহে প্রতিটি গ্রামে,গঞ্জে।
আগরতলা মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আন্দোলন ও ছয় দফা,এগার দফার আন্দোলনে ‘ নেত্রকোণা মহকুমা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের’অন্যতম নেতা হিসাবে নেতৃত্ব দেন। এর মাঝে তিনি স্কলারশিপে উচ্চ শিক্ষার জন্য জাপান যাবার সুযোগ পান। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ বাড়ীতে নেতার আশীর্বাদ নিতে গেলেন।
সেসময় বঙ্গবন্ধু বললেন,’তোদের নিয়ে আমি বাঙ্গালীর মুক্তির স্বপ্ন দেখি। তোরা যদি না থাকিস তাহলে কিভাবে হবে। যাস না, দেশটা স্বাধীন হলে সব পাবি। ‘
আর জাপান যাওয়া হল না গোলজার হোসেনের।
এর মাঝে ১৯৭০ নেত্রকোণা সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বিপুল ভোটে “ভি.পি” পদে নির্বাচিত হলেন। ১৯৭০ সনে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ‘ নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর সাথে নেত্রকোণায় নৌকার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালান। ভাটি বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নৌকার প্রচারণা চালান। সেই প্রথম বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন মোহনগঞ্জের গাগলাজুড়ে।
১৯৭১ সনে অসহযোগ আন্দোলনে নেত্রকোণা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে সারা জেলায় মুক্তিযুদ্ধা রিক্রুট থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের রসদ সংগ্রহের নেতৃত্ব দেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সনে মুজিব বাহিনীর উপ- আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। দেরাদুনের ভারতীয় আর্মি হেড কোর্য়াটারে প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। মুজিব বাহিনীর মটিভেটর হিসাবে তোড়া জুনে মুক্তিযুদ্ধাদের মোটিভেট করেন মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মণির নির্দেশে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের যুব সমাজকে একত্রিত ও গঠনমূলক দেশ গড়ার কাজে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৭২ সনে আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত করেন গোলজার হোসেন কে। একি সাথে নেত্রকোণা জেলা যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে নেত্রকোণায় যুবলীগকে শক্তিশালী করতে কাজ করেন।
সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের বিরোধীতা করে কতিপয় ছাত্রনেতার নেতৃত্ব বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে জাসদ যখন সারাদেশে ছাত্রলীগকে বিভক্ত করে ষড়যন্ত্র, সংঘাতের অপ- রাজনীতি শুরু করে তখন জনাব গোলজার হোসেন নেত্রকোণা জেলা ছাত্রলীগকে সুসংবদ্ধ রাখতে থানায় থানায় সাংগঠনিক কাজ করেন।
১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধু কৃষক, শ্রমিক মেহনতী মানুষের জন্য শোষিতের গণতন্ত্র ও বাঙ্গালীর সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে ২য় বিপ্লব কর্মসূচী বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন এবং জনাব গোলজার হোসেন কে নেত্রকোণা জেলা বাকশালের সম্পাদক মনোনীত করেন।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ৭১ এর পরাজিত শক্তি, কতিপয় দালাল কুলাঙ্গার মীরজাফরের বংশধর। সে রাত্র ঢাকায় গ্রেফতার হন গোলজার হোসেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আর্মি কনসানট্রেশন ক্যাম্পে। নির্মম নির্যাতন ও মৃত্যু ভয় সেদিন তাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। ২৮ দিন পর মুক্তিযুদ্ধা পুলিশ অফিসারের সহায়তায় সেখান থেকে পালাতে সমর্থ হন গোলজার হোসেন। তারপর তিনদিন সে পুলিশ অফিসারের বাড়ীতে থেকে আত্মগোপনে চলে যান।সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে পালিয়ে যান ভারতে। কাদের সিদ্দীকি ও মুষ্টিমেয় কতিপয় বঙ্গবন্ধু প্রেমিক সেদিন প্রতিবাদ করেছিল ও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল ।১৯৭৬ সালে সচিবালয়ের সামনে থেকে আর্মিরা গ্রেফতার নিয়ে যায় আর্মির ইন্টারোগেশন সেলে। সেখানে আর্মির নির্মম অত্যাচার ও জিয়ার প্রলোভন গোলজার হোসেনকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শচ্যুত করতে পারেনি।
তিনি সেদিন বলেছিলেন,” বঙবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যেদিন গিয়েছিলাম সেদিনই মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে ছিলাম, আপনারা আমাকে মেরে ফেলতে পারেন তবে আমাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারবেন না, আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করে যাব।”
খালেদা জিয়া সরকার গোলজার হোসেনের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারী করেন। দেখা মাত্রই গুলি করার নির্দেশ প্রদান করেন। সাড়ে চার বৎসর আত্মগোপনে থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বদলা ও আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন নেত্রকোণা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠিক সম্পাদক হিসাবে। ১৯৭৯-১৯৮৩ সনে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৩ -১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের অন্যতম প্রেসিডিয়াম মেম্বার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৫-১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮১ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রথম নেত্রকোণা মোক্তারপাড়ার মাঠে ঐতিহাসিক জনসভায় আসেন, সেদিন গোলজার হোসেন তালুকদার সেই মিটিংটি পরিচালনা করেছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে।