
বিশেষ প্রতিনিধি: নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের আরো ১৫ জনকে খুঁজছে পুলিশ। আট জনের দুই দিনের রিমান্ডে দেয়া তথ্যে পুলিশ অনেকটা নড়েচড়ে বসেছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের গ্রেপ্তার ৩২ জনের মধ্যে ৮ জন দুই দিনের পুলিশী হেফাজতে দেয় আদালত। বুধবার রিমান্ড শেষে তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালত তাদেরকে কারাগারে পাঠায়।
পুলিশ ও এলাকাবাসি সূত্র জানায়, এর আগেও অন্তত তিনবার প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় একই কায়দায় প্রশ্ন ফাঁস করে ও নির্দিষ্ট পরীক্ষার্থীদের উত্তর সরবরাহ করে অর্থ হাতিয়েছে। এবার তারা ২০ জন পরীক্ষার্থীকে টার্গেট করে মিশনে নেমেছিল বলে বলছে পুলিশকে। তারা একেকজন প্রার্থীর কাছ থেকে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকায় রফা করে।সবার কাছ থেকে পুরো টাকা হাতিয়ে নিতে পারেনি।কারও কারও কাছে টাকা বকেয়াও ছিল বলে জানিয়েছে জিজ্ঞাসাবাদে। তবে পুলিশ বলছে, অন্তত ৫০ জন পরীক্ষার্থীকে এই প্রশ্ন ফাঁসকারি চক্রের সদস্যরা এবার টার্গেট করেছিল, এমন তথ্য তাদের কাছে রয়েছে।এই চক্রের মুলহোতা বলাইশিমুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান ছোটন। সে গত প্রায় এক দশকে তার গড়ে তোলা এই প্রশ্নফাঁস চক্রে অন্তত ৬০জনকে ভিড়িয়েছেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।এদের মধ্যে তার আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। এছাড়াও ছোটন টার্গেট করে করে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের মেধাবি শিক্ষার্থীদের অর্থের লোভ দেখিয়ে চক্রে নাম লিখিয়েছেন। এই চক্রের মাধ্যমে ছোটন বিত্ত বৈভব গড়েছেন। কেন্দুয়া পৌর শহরে নির্মাণ করেছেন বাড়ি, এছাড়াও ৪৬ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি। স্ত্রীর নামে পোষ্ট অফিসে রেখেছেন টাকা। এলাকার হাওরেও রেখেছেন জমি। বেনামেও রয়েছে অনেক সহায়-সম্পদ। কেন্দুয়ায় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছেও তিনি ব্যবসায় খাটাচ্ছেন টাকা ।
এ সবই তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন, নেত্রকোণা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো: শাহজাহান মিয়া । তিনি জানান, যাদেরকে পুলিশ খুঁজছে তাদের মধ্যে নেত্রকোণা সদরের কৃষ্ণগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ঝন্টু সরকার, নেত্রকোণা শহরের উন্মেষ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আরিফুল ইসলাম রিপন, নেত্রকোণা সরকারি কলেজের শিক্ষক আব্দুল মমিন রয়েছেন।এরা মামলার আসামী। তদন্তের স্বার্থে বাকিদের পরিচয় জানাননি তিনি।
তিনি বলেন, সব দিক মাথায় রেখে পুলিশ তদন্ত করছে।এই চক্রের মাধ্যমে ছোটনের হাতিয়ে নেয়া অর্থের দিকটিও তদন্তে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মানি লন্ডারিংয়ের মামলাও হতে পারে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরো জানান, মামলার তদন্তের স্বার্থে আসামীদের আরো জিজ্ঞাসাবাদ করতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কারাগারে থাকা আরো আসামীকে আদালতের মাধ্যমে পুলিশী হেফাজতে আনা হতে পারে।
শুক্রবার (২৮ জুন) নিয়োগ পরীক্ষা চলাকালে কেন্দুয়ার টেংগুরি এলাকার ব্যবসায়ী শামিম আহমেদের বাড়ি থেকে ৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের প্রশ্ন ফাঁসকারি চক্রের সদস্য বলছে পুলিশ। এদের মধ্যে ১১ শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ৯৭ জনের বিরুদ্ধে থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে মামলা করে। পরে শনিবার আদালতে পাঠানোর আগে গ্রেপ্তারদের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে পুলিশ।
“পরীক্ষার হলে পরিদর্শক হিসেবে থাকা এই চক্রের সদস্যরা পরীক্ষা শুরুর সাথে সাথে প্রশ্নটা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাইরে তাদের অন্য সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। বাইরে থাকা চক্রের অন্যরা দ্রুত প্রশ্নের উত্তর লিখে আবার সেই পরিদর্শকদের কাছে একইভাবে পাঠিয়ে দেয়।”
পরে তারা তাদের নির্দিষ্ট পরীক্ষার্থীদের তা সরবরাহ করে এবং পাশে দাঁড়িয়ে থেকে উত্তর লিখতে সহযোগিতা করে বলে তিনি জানান। “এভাবে তারা একেক পরীক্ষার্থীকে অন্তত ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ নম্বর পাইয়ে দেয়। এরা ৫ থেকে সাত বছর ধরে এভাবে প্রশ্ন ফাঁস করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল।
প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্য সন্দেহে শুক্রবার ৩২ জনকে আটকের সময় তাদের কাছ থেকে ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ডিভাইস ও প্রিন্টার জব্দ করে পুলিশ।
এই চক্রে জড়িয়ে বরখাস্ত শিক্ষকেরা হচ্ছেন-কেন্দুয়া উপজেলার বলাইশিমুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান ছোটন, বড়বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সাকি ও পানগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুহিন আক্তার, কেন্দুয়া উপজেলার দিগদাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মজিবুর রহমান, নওপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাওয়া বেগম, লিপা মুনালিসা, বলাইশিমুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মরিয়ম আক্তার, কেন্দুয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাহমিনা আক্তার, মদন উপজেলার জঙ্গলটেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জেবুন্নাহার ডলি, খাগরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক লাকি আক্তার, ও আটপাড়া উপজেলার তেলিগাতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্মৃতি খানম।এরা এখন কারাগারে আছেন।
এদিকে পুলিশী হেফাজতে যাদেরকে নিয়েছিলেন তারা হলেন, বলাইশিমুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান ছোটন, নওপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আজহারুল ইসলাম, শরিফুজ্জামান ভূইয়া মিন্টু, দিগদাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষক মজিবুর রহমান, বিকাশ দে, জুয়েল মিয়া , আবুল বাশার, বিলাস সরকার।