পূর্বধলায় যৌতুক না পেয়ে গৃহবধূকে পৈশাচিক নির্যাতনের অভিযোগ

বিশেষ প্রতিনিধি: বিশেষ প্রতিনিধি: নেত্রকোণার পূর্বধলায় যৌতুকের জন্য বন্যা আক্তার (২৩) নামে এক গৃহবধূকে হাত-পা বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠেছে তাঁর স্বামীসহ শ্বশুর বাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে। গুরুতর আহত অবস্থায় গত শুক্রবার বিকেলে ওই গৃহবধূকে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।বর্তমানে তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
গত শুক্রবারের এ ঘটনায় রোববার বিকেলে বন্যার ছোট ভাই শরিফ আল বেলাল পূর্বধলা থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন, গৃহবধূর স্বামী ফারুক আহম্মেদ, ফরুকের বড় ভাই খোকন মিয়া, তাঁর স্ত্রী হুসনা আক্তার, শহিদ মিয়া, তাঁর স্ত্রী আজমিনা আক্তার ও ফারুকের মা রাহিমা আক্তার। তাঁদের প্রত্যেকের বাড়ি পূর্বধলার শিমুলকান্দি কুড়পাড় এলাকায়। তাঁদের মধ্যে ফারুক আহম্মেদ বিজিবির সদস্য। তিনি চট্টগ্রামে ৮ ব্যটেলিয়নে কর্মরত। বর্তমানে দুই মাসের ছুটিতে আছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা, পুলিশ ও নিযাতনের শিকার ওই গৃহবধূর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালের জুন মাসে নেত্রকোণা শহরের সাতপাই এলাকার মৃত আব্দুল হেকিমের মেয়ে বন্যা আক্তারের সঙ্গে পূর্বধলার শিমুলকান্দি গ্রামের মৃত জহুর উদ্দিনের ছেলে ফারুক আহম্মেদের বিয়ে হয়। বিয়ের বছর খানেক পর থেকে ফারুক ও তাঁর মা-ভাইসহ বাড়ির লোকজন বন্যাকে যৌতুকের জন্য বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিকভাবে নিযাতন করা হত। নিযাতন সইতে না পেরে বন্যা বেশ কয়েকবার তাঁর বাবার বাড়ি থেকে বেশ কিছু টাকা এনে দেন। কিন্তু গত দুই বছর ধরে বন্যার স্বামী ও তাঁর শ্বশুর বাড়ির লোকজন বন্যাকে তাঁর বাবার সাতপাই এলাকার বাসায় ৫ শতক জায়গা যৌতুক হিসেবে দিতে চাপ দেন। কিন্তু বন্যা ও তাঁর বাবার বাড়ির লোকজন এতে রাজি হননি। এর পর থেকে বন্যার ওপর নিযাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। বিশেষ করে ফারুক চাকুরি থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে এলেই নিযাতন চরম আকারে রূপ নিত। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার গ্রাম্য সালিস করা হয়। সর্বশেষ গত বছর এপ্রিলের দিকে পূর্বধলা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। পরে থানার তখনকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অভিরঞ্জন দেব বন্যা ও তাঁর শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের নিয়ে বসে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করেন। ওসি বন্যার ভাসুর দেবরসহ অন্যান্যদের সর্তক করে দেন একই সঙ্গে তাঁদেরকে বন্যার কাছে অপকর্মের জন্য মা চাওয়ান। পরে অবশ্য বন্যা ওই ঘটনার পর তাঁর বাবার বাড়িতে চলে আসেন। এ দিকে ফারুক আহম্মেদ দুই মাসের ছুটি পেয়ে সম্প্রতি বাড়িতে এসেছেন। তিনি গত বুধবার বন্যার বাবার বাড়িতে এসে পর দিন বন্যাকে নিয়ে তাঁদের শিমুলকান্দি বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে আবারো ওই পাঁচ শতক জায়গার জন্য বন্যাকে চাপ প্রয়োগ করেন। বন্যা এতে রাজি না হওয়ায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে তাঁর ওপর অমানসিকভাবে নিযাতন চালালিয়ে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। খবর পেয়ে গত শুক্রবার দুপুরের দিকে বাবার বাড়ির লোকজন গিয়ে বন্যাকে উদ্ধার করে নেত্রকোণা আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। গত শনিবার রাত ১১টার দিকে ওই হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের ৩২ নম্বর শয্যায় গিয়ে দেখা গেছে, যন্ত্রনায় বন্যা আক্তার কাতরাচ্ছেন। তাঁর মা আল মিনা আক্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এ সময় খবর পেয়ে নেত্রকোনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ ফকরুজ্জামান জুয়েল, নেত্রকোণা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তাজুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বন্যাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে আসেন।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্যা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী, দুই ভাসুর খোকন, শহিদ, তাঁদের স্ত্রী হুসনা, আজমিরা ও শাশুড়ি রাহিমা এই পাঁজন মিলে টানা দুই ঘণ্টা পর্যন্ত আমার ওপর নির্যাতন চালান। কিল ঘুষি ছাড়াও তাঁরা কাঠের চেলা দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধোর করেন। এক পযায়ে আমার স্বামী গোপনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে আঘাত করেন। পরে তারা ঘর তালাবদ্ধ করে রাখেন। এসব কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বন্যার অভিযোগ, তাঁর স্বামীসহ শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাঁকে সন্তান ধারণ করতে দেয়নি। অনেক কৌশলে একবার প্রথম সন্তান ভূমিষ্ট হয়ে কিছু দিন পর মারা যাওয়ার পর আবার গর্ভ ধারণ করেন। পরে পেটের ব্যাথা হলে ওই পরিবারের লোকজন মিলে গ্যাসের ওষুধের কথা বলে একটি বড়ি তাঁকে খাইয়ে দেওয়া হয়। এতে করে তাঁর তিন মাসের গর্ভের সন্তান নষ্ট করে দেওয়া হয়। বিষয়টি ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রমাণ মিলেছে বলে বন্যার দাবি।’
বন্যার মা আল মিনা আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়েটি সাদাসিধে। লেখাপড়ায় ভালো ছিল। আইয়ে পাশ করার পর ভালো ছেলে জেনে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওরা এমন বর্বর তা জানা ছিল না। স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করি। আমি ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’


খবর পেয়ে দেখতে আসা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরুজ্জামান জুয়েল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওই গৃহবধূর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবিকারা জানিয়েছেন তাঁর স্পর্শকাতর স্থানেও আঘাত করা হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।’
নেত্রকোনা সিভিল সার্জন তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ওই গৃহবধূকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। তবে স্বাভাবিক হতে আরো কিছু দিন সময় লাগবে।’
এ দিকে, ঘটনার পর গত শনিবার রাত থেকে ফারুক ও তাঁর বাড়ির লোকজন পলাতক রয়েছেন। পূর্বধলা থানার ওসি মো. তাওহিদুর রহমান রোববার বিকেল তিনটার দিকে বলেন, ‘আসামিরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। তাঁদের ধরতে অভিযান চলছে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্যার স্বামী ফারুক আহম্মেদ মুঠোফোনে গতকাল বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বলেন, ‘আমার স্ত্রীর অভিযোগ সত্য নয়। ওর পাগলামির স্বাভাব আছে। আমাকে শুক্রবার দিন দা দিয়ে কানের কাছে আঘাত করেছে। অপর প্রশ্নের জবাবে বলেন, ওর শরীর তো ফর্সা তাই একটু ধরলেই দাগ হয়ে যায়। আর কিছু দিন আগে একটি বাচ্চা নষ্ট হয়েছে তাই হয়েতো দৌড়াদৌড়ি নাচানাচি করায় ওই স্থান থেকে রক্ত যাচ্ছে।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।