নেত্রকোণার হরিজন পল্লীর প্রিয়া হতে চায় পুলিশ কর্মকর্তা,পায়েল শিক্ষক

বিশেষ প্রতিনিধি: তারা দু’জনই নিতান্ত গরিব ঘরের সন্তান। ঠিক মতো খাবারই জোটে না। কিন্তু এতে তারা দমেনি। তারা দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশোনা চালিয়ে ছিনিয়ে এনেছে একের পর এক সাফল্য। এমন কি-ঠেকিয়েছে নিজেদের বাল্যবিবাহ। এরই ধারাবাহিক এবার তারা এসএসসি পাশ করেছে। এ যেন দুঃখের ঘরে সুখের আলো।
তারা হলো প্রিয়া বাশফোর ও পায়েল বাশফোর। তারা একে অপরের আপন মামাতো ফোফাতো বোন। তাদের ঘরও পাশাপাশি। দু’জনই একই স্কুলে পড়ে এক সঙ্গেই বেড়ে উঠেছে। তারা নেত্রকোণা শহরের চকপাড়া এলাকায় হরিজন পল্লীতে বসবাস করে। তাদের মধ্যে লেখাপড়া করে প্রিয়া পুলিশের বড় কর্মকর্তা হয়ে হরিজনদের দুঃখ ঘোচাতে চায়। আর পায়েল শিক্ষক হয়ে তাদের সম্প্রদায়ে আলো বিলাতে চায়।
প্রিয়ার বাবা সুবাস বাশফোর একজন ঝাড়ুদার। সারা দিন খেটে যা পান তা দিয়েই চালাতে হয় সংসার আর তিন মেয়ে এক ছেলের পড়াশোনা। মা মিনতি বাশফোর গৃহিণী। সন্তানদের মধ্যে প্রিয়া সবার বড়। মেজবোন চাঁদনী বাশফোর দশম শ্রেণিতে আর সোনালি বাশফোর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একমাত্র ভাই সুবীর বাশফোর প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।
আর পায়েলের বাবা-মাও ঝাড়ুদার। তাদের সংসারেও দুঃখ নিত্য দিনের সঙ্গী। বাবা ইমরিত বাশফোর, মা মালতি বাশফোর দিন-রাত খেটেখুটে যা পান তা দিয়ে চলতে হয়। পায়েরা এক ভাই, এক বোন। পায়েলই সবার বড়। ভাই আশিক বাশফোর শহরের সাতপাই এলাকায় নেত্রকোণা উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দা, বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ওই দুই শিক্ষার্থীর পারিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, ‘প্রিয়া ও পায়েল শহরের বীণাপাণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে। অবশ্য তখন তাদের স্কুলে যাওয়া-আসা, পড়াশোনা অতটা সুখকর ছিল না। এক দিকে গরিব ও নিচু জাত। অন্যদিকে, বাবা-মার পেশার কারণে অনেক শিক্ষার্থীরাই তাদের সঙ্গে মিশতে চাইতো না। ভালো ব্যবহারও করতো না। তবুও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে প্রিয়া পায় জিপিএ ৩.৭৯ আর পায়েল ৪.৫০ লাভ করে। তারপর ভর্তি হয় শহরের সাতপাই এলাকায় আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে। তাদের ভাষ্য মতে, ওই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই তাদের উভয়ের চিন্তা চেতনা পাল্টে যায়। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করেন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও জেলা উদীচীর নৃত্য বিভাগের প্রশিক্ষক তমা রায়। তমা রায়ের অনুপ্রেরণায় মেয়ে দুইটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এরই মধ্যে ২০১৫ সালে তাদের পৃথক দুইটি পরিবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। তখন তারা সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। কিন্তু শিক্ষক তমা রায়কে সঙ্গে নিয়ে নিজেরাই নিজেদের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দেয়। এরপর জেএসসিতে প্রিয়া পায় জিপিএ- ৩.৭৯ আর পায়েল পায় জিপিএ-৪। এবার এসএসসিতে ওই স্কুলের বাণিজ্য শাখা থেকে প্রিয়া ও পায়েল উভয়েই জিপিএ-৩.৬১ অর্জন করে। সোমবার ফলাফল প্রকাশ হলে দুপুর দেড়টার দিকে তমা রায় মুঠোফোনে এই সাফল্যের খবর দেন। পরে ওই দিন বিকেল পৌনে তিনটার দিকে ওই মেয়ে দুইটির বাসায় গিয়ে দেখা যায় তাদের পরিবারের লোকজন ও সম্প্রদায়ের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে। অস্বাস্থ্যকর দম বন্ধকরা ঘিঞ্জি পরিবেশে ছোট ছোট জীর্ণদশা ঘরে-বাইরে রং খেলা নিয়ে উল্লাসে মেতেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কলনিতে বসবাসকারী ৩৫টি ঘরের প্রায় তিন শতাধিক লোকের মধ্যে প্রিয়া ও পায়েই হলো প্রথম এসএসসি পাশ করা মেয়ে। এ ছড়া প্রিয়ার চাচাতো ভাই রাসেল বাশফোড় গত বছর এসএসসি পাশ করে এবার একাদশ শ্রেণিতে আবু আব্বাস ডিগ্রি কলেজে পড়ছে। কথা হলে প্রিয়া বাশফোর বলে, ‘আমি লেখাপড়া করে পুলিশের বড় কর্মকর্তা হয়ে হরিজনদের দুঃখ ঘোচাতে চাই।’ আর পায়েল বাশফোর বলে, ‘আমি তমা ম্যাডামের মতো একজন ভালো শিক্ষক হয়ে আমাদের সম্প্রদায়ে মধ্যে আলো বিলাতে চাই।’ তাদের উভয়ের মা-বাবার সঙ্গে কথা হলে জানান, তাদের এক চিলতে থাকার ঘরটি ছাড়া আর কিছুই নেই। ছোটকাল থেকেই মেয়ে দুইটি খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয়েছে। কখনো বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে নিজস্ব পেশায়। এখন পাশ করলেও কলেজে ভর্তি হতে এবং পড়াশোনা চালাতে যে টাকার প্রয়োজন, তা সামর্থ্য পরিবারের না থাকায় দুশ্চিন্তা তাড়া করছে তাদের।’
শিক্ষক তমা রায় বলেন, ‘আজ আমার শুধুই আনন্দ আর আনন্দ। ওই মেয়ে দুইটি আমাদের স্কুলের গর্ব। ওরা নিজেদের জয় করতে শিখছে। ওরা নৃত্য এবং নাটকেও ভালো পারদর্শী। আমরা শিক্ষকরা তাদের অভিভাবকের দৃষ্টিতে দেখতাম এবং প্রয়োজনে সাধ্যমত সহযোগিতা করতাম। তিনি আরো বলেন, ‘আমার জানা মতো নেত্রকোনায় এই প্রথম হরিজন সম্প্রদায়ের কোন নারী মাধ্যমিক পাশ করেছে। ওরা সহযোগিতা পেলে আরো সামনে এগিয়ে যাবে।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।