খালিয়াজুরীর হাওরে বোরো ধানে চিটা : দিশাহারা কৃষক

শফিকুল ইসলাম তালুকদার খালিয়াজুরী থেকে: ধানে চিটা ও ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন হাওরপারের কৃষক। উঠতি বোরো ধানে এ বিপর্যয়ে তারা এখন দিশাহারা। মাত্র কয়েকদিন আগে যে কৃষক সোনার ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখতেন তারা আজ ধান ক্ষেতের আইলে বসে ডুকরিয়ে কাঁদছেন। ৮ একর জমির ব্রিধান-২৮ মারাই করে মাত্র ৮০ মণ ধান পেয়েছেন খালিয়াজুরীর সরকার হাটির কৃষক কাচু মিয়া। অর্থ্যাৎ একর প্রতি তিনি ফলন পেয়েছেন মাত্র ১০ মণ ধান। অথচ বরাবর তার এ জমিতে কমপক্ষে ৩৬০ মণ থেকে ৪০০ মণ ধান উৎপাদন হয়। শুধু কাচু মিয়াই নয় এই হাওরের হাজার হাজার কৃষকের হয়েছে এমন অবস্থা। এই কৃষককূল সব সময় বৈরী প্রকৃতি ও আগাম বন্যার ঝুকিতে থাকেন। পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে প্রায় প্রতি বছর আগাম বন্যায় তলিয়ে যায় কৃষকের সোনালী ফসল। এখন হাওরপারের কৃষক পরিবারগুলোতে বোরো ধান কাটা মাড়াইয়ের ধুম লাগার কথা ছিল। কিন্তু এবার সেই আমেজ নেই। অনেকের ঘরে শোকের আবহ। ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার আহাজারি। কোনো কোনো কৃষক ধান কাটাছেন ঠিকই কিন্তু ধানের ছড়ায় ধান নেই বেশীর ভাগই চিটা (ফাঁকা ধান)। এসব দেখে কৃষি বিভাগও রীতিমত কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কৃষি বিভাগের বিশেষজ্ঞরা এ সমস্যাটির নাম দিয়েছেন কোল্ড ইনজুরি। খালিয়াজুরী কৃষি অফিসের সূত্রমতে ০৬ টি ইউনিয়নে এবার ১৯ হাজার ৮ শত ৭০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়। এর মধ্যে কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী চিটায় আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার হেক্টর জমি। তবে বেসরকারী সূত্র ও স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায় প্রকৃত আক্রান্ত জমির সংখ্যা আরো অনেক বেশী। বিশেষ করে, খালিয়াজুরীর পাংগাসিয়া, কির্তনখোলা, কটিচাপরা, সেনের বিল, জালর বন, সোনাতোলা, বল্লীর চৌতরা, জগন্নাথপুরের বড় হাওর, বাজজোয়াইল, পাঁচহাট, নগর, বোয়ালী, চাকুয়ার হাওরের হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল চিটায় পরিণত হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায় খালিয়াজুরীর সদরের মোঃ রাজু মিয়া ২০ একর জমিতে বোরো ধানের চাষ করেন এর মধ্যে চিটা হয়েছে ১১ একর জমিতে। বহিরাগত কৃষক (জিরাতি) মোঃ হারুন-অর-রশিদ আবাদ করেছেন ৭০ একর তার আক্রান্ত হয়েছে ৩০ একর। অনল মিয়ার ৫ একরের মধ্যে সম্পুর্ন জমিতে চিটা হয়েছে। এইভাবে বল্লী গ্রামের বাবুল মিয়া ১৫ একর জমি চাষ করেন এর মধ্যে চিটা হয়েছে ১৩ একর। ওই গ্রামের নেহের মিয়া ৭ একর জমি চাষ করে এক মুট ধানও পায়নি। একইভাবে খালিয়াজুরীর রফিকুল ইসলাম ছোটনের ৬ একরের মধ্যে ৩ একর জাহের মিয়ার ৩ একরের মধ্যে ২ একর এবং গছিখাই গ্রামের শফিকুলের ১৫ একরের মধ্যে ১০ একর চিটায় আক্রান্ত হয়েছে। হাওরের গ্রামগুলোতে এরকম কৃষকের সংখ্যা আরও বহু। আক্রান্ত কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখা যায় এসব জমির ধানের ছড়া সোজা হয়ে উপরের দিকে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ধানের ভারে ছড়া নীচের দিকে নুয়ে থাকে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা জানায় বিগত বছরগুলোতে ১ একর (১০ কাঠা) জমিতে কম করে হলেও ৬০ মণ ধান উৎপন্ন হয়েছে। এবার একরে ১০ মণ ধানও হয়নি। এতে করে অনেকের উৎপাদন খরচও উঠবেনা। কেন হল এমন অবস্থা? এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম উপজেলা কৃষি অফিসার, মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের কাছে তিনি জানান জমির ফ্লাউয়ারিং স্টেজের পর ধানের ছড়ায় দানা গঠন (চাল) হয়। এজন্য নির্দ্দিষ্ট তাপমাত্রার প্রয়োজন পরে। কিন্তু এবার তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকায় ধানের মধ্যে ঠিকমত দানা গঠন হয়নি। এর ফলে অনেক জমিতে চিটা ( ফাঁকা ধান) হয়। এ সমস্যাটিকে বলা হয় কোল্ড ইনজুরি বা ঠান্ডাজনিত কারণ। কয়েকজন উপসহারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, যে সমস্ত কৃষক জমিতে আগাম চারা রোপন করেছেন তাদের জমি আক্রান্ত হয়েছে বেশী। এর মধ্যে বিশেষ করে ব্রিধান-২৮ ধানের জমিই বেশী আক্রান্ত হয়েছে। তবে কৃষকরা জানান অপেক্ষাকৃত নীচু এলাকা হওয়ায় এবং আগাম পানি চলে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি চারা রোপন করা হয়। অতিথে এমন সমস্যায় পড়েনি। এ ব্যাপারে খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লোকমান হেকিম প্রতিনিধিকে বলেন সমস্যা যেন কৃষকের পিছু ছাড়ছেনা। সাধারণত এনজিও, ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়ে হাওরের কৃষকরা জমি চাষাবাদ করে। কিন্তু এবার ফসল বিপর্যয় হওয়ায় অনেক কৃষকের পক্ষে গরু, বাছুর, বাড়িঘর বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।