
১৯৭১ সনে,পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এদেশের জনগন বড় ভূমিকা গ্রহন করেছে। লাখো লাখো মানুষ এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। পাশবিকভাবে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে অগনিত মা-বোন, অগনিত পরিবার হয়েছে নিঃস্ব। তবুও দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে পিছ পা হয়নি এদেশের মানুষ।
স্মৃতি-১: নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টা উপজেলার ফকিরের বাজার সংলগ্ন চল্লিশ কাহনিয়া গ্রামে ফকির বাড়ীতে ১৯৬৭সনে আমার জন্ম। আমার স্মৃতিকথা আমার পরিবার থেকেই শুরু করলাম। আমার চাচা ফকির মৌলা দুঃসাহসী একজন যোদ্ধা। তিনি বীরত্বের সাথে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদেন। আমাদের গ্রামের আরো যারা সাহসিকতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন তাঁরা হচ্ছেন- প্রফেসর আব্দুস ছোবাহান (চাঁনমিয়া), আবু হোসেন (প্রয়াত), বাবু সুনিল চন্দ্র কর্মকার, বাবু জীবন চন্দ্র কর্মকার (প্রয়াত), শেখ আলী হোসেন প্রমূখ। আমি আরো দুএকজনের নাম না বলেলই নয়, কান্দাপাড়া গ্রামের আব্দুল ওয়াহেদ আহম্মেদ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। তিনি আমারও শিক্ষক ছিলেন। স্যারের সঙ্গে আরো দুজন সংগঠক ছিলেন- দুধকোড়া গ্রামের আব্দুর রহমান খান গণি মিয়া (প্রয়াত) , বাট্টাপাড়া গ্রামের আব্দুল মালেক (প্রয়াত) প্রমূখ।
স্মৃতি-২: যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই রাজাকারদের অত্যাচারের কারণে আমার বড় ফুফু ও ফুফা ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের বাড়ীতে চলে আসেন, এমনকি গরুছাগলসহ। ফুফু আমাকে খুব আদর করতেন । একদিন কাদঁতে ছিলাম, তিনি আমাকে কুলে নিয়ে বাংলা ঘরের দিকে গেলেন। বাংলা ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। বিশ-পচিঁশ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা থাকত। আমার কান্না থামানোর জন্য একটা বন্দুক উঠাতে বললেন, ভীষণ ওজন উঠাতে পারলাম না, কান্না থেমে গেল। ভাবতে লাগলাম কাঠের একটা বন্দুক এত ওজন ? ফুফু আমাকে নিয়ে বাড়ীর ভিতরে চলে এলেন।
স্মৃতি-৩: বাংলা ঘরের সামনে আমি দাড়িয়ে ছিলাম। ক্লান্ত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা আজিজ সাহেব আমাকে বললেন- আনোয়ার, তুমি ঘর থেকে এক জগ পানি ও একটা গ্লাস তাড়াতাড়ি নিয়ে আস। ঘরে গিয়ে মাকে বললাম, মা আমার হাতে এক জগ পানি ও একটি গ্লাস দিলেন। এক জগ পানি আমি নিতে পারিনি, তাই মা আমাকে আধা জগ পানি ও গ্লাসটি হাতে তুলে দিলেন। বাংলা ঘরে গিয়ে জগ ও গ্লাস আজিজ সাহেরেব হাতে দিলে তিনি আমাকে একটা ধন্যবাদ দিলেন ও মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন।
স্মৃতি-৪: পাশের বাড়ির গোলাপ মিয়া, বাবার ফুফাত ভাই হয়। বয়স নয়/দশ। সে ছিল খুব চঞ্চল ও আন্তরিক। প্রায়ই আমাদের বাড়িতে খবর নিয়ে আসত, সাংবাদিকের মতো। হত্যা,গোলাগুলি ইত্যাদি ইত্যাদি। একদিন সে দৌড়ে আসল তিন ডাকাতের খবর নিয়ে। আমাকে লক্ষ করে বলল-“তুই তো দেখছস না আসইরা নসইরা হেরা তিন ভাইরে মুক্তিবাহিনীরা ধইরা আনছে। আইনা ঘরের পালার সাথে বাইন্দা ব্লেইড দিয়া ছিইরা লবণ লাগাইতাছে, আর বাবাগো মাগো কইতাছে।” গোলাপ চাচার কাছে এই খবর শুনে আমার ইচ্ছে হচ্ছিল এই ডাকাতদের দেখার জন্য। কিন্তু আমি ছোট মানুষ বয়স মাত্র চার, মা আমাকে ছাড়লেন না,তাই দেখা হলো না। ওরা ছিল আমাদের এলাকার কুখ্যাত ডাকাত। এদেরকে সব মানুষ ভয় পেত। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দুজনকে গুলি করে কংশ নদীতে ফেলে দেয়। ডাকাতের মায়ের কান্নায় আর কাকতি মিনতিতে ছোট ছেলেকে ছেড়ে দেয়।
স্মৃতি-৫: সকালে ঘুম থেকে ওঠে চোখ কচলাতে কচলাতে আমি বাংলা ঘরের দিকে যাই। দেখি কজন মুক্তিযোদ্ধা কুখ্যাত একটা চোরকে ধরে এনে পিটাচ্ছে। হইহোল্লা শুনে আসপাশের মানুষ আমাদের বাড়িতে এসে জড়ো হয়। কিছুক্ষণ পর ভিতর বাড়ি থেকে দাদাও এলেন এখানে। দাদাকে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা থেমে গেল। তিনি চোরকে উদ্দেশ্য করে বললেন- তুমি সারাজীবন চুরি ডাকাতি করেছ, আজ তোমার উপায় নেই। তুমি মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পন করে ভাল মানুষ হও। ও যুদ্ধের কাজে সহযোগিতায় নেমে যাও। দাদার কথা শুনে চোর ঠিক সেই কাজটিই করল। সে আর কোনদিন চুরি করেনি। সারাক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের সেবায়ই রয়েছে সে।
স্মৃতি-৬: কাচেঁর বোতলের গডগড শব্দ শুনলে মনে হতো যেন আজ মঙ্গলবার। আমাদের ফকিরের বাজারে সপ্তাহে বড় হাট বসে। চারিদিক থেকে লোক আসত ঝাকে ঝাকে। মানুষের রব আর তেল নেয়ার কাচেঁর বোতলের শব্দে কান রাখা যেত না। ফকিরের বাজার হইতে দেড় কিলোমিটার উত্তরে বাক্রী নদী। নৌকা দিয়ে যাচ্ছিল পাকিস্তানি পাচাটা রাজাকার বাহিনী। গুলাগুলি শুরু হয়, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদেরকে বললেন- বাড়ির দক্ষিণ দিকে শুয়ে থাকেন, আমার দাদী নামাজের মুচলা এনে আমাকে নিয়ে শুয়ে রইলেন, যতক্ষণ গুলাগুলি হয়। আমাদের সাথে শুয়েছিল কজন হাটওয়ালা। তারা বাজারে যাচ্ছিল। একজন-আরেকজনকে জিজ্ঞেস করে, তর বোতল কই, ঠিকইতো আমার হাতে তো শুধু বোতলের সুতলিডা আছে। আরেকজনে বলল গুলাগুলি শেষ হোক পরে তো বোতলের আলাপ। রাজাকারদের গুলি শেষ, মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়ে নৌকার দিকে যায়, গিয়ে দেখে রাজাকাররা সব পালিয়ে গেছে উত্তর দিকে। রাজাকারদের উদ্দেশ্য ছিল ফকিরের বাজারকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাড়কার করে দেয়া।
স্মৃতি-৭: এটি একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা। বাবার খালাত ভাই, নেত্রকোণা জেলার সদর উপজেলার কুনাপাড়া গ্রামে জন্মেছিলেন, নাম আব্দুল বারী (তারা মিয়া)। পিতা: মৃত জাবেদ আলী, মাতা: জাহেদা খাতুন। তিনি পাকিস্তান আমলে আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। একাত্তর সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পূর্বে বদলী করে নেয়া হয়, বগুড়া সেনানিবাসে। তার পদবী ছিল নায়েব রিসালদার ও বিজেও নং ছিল-১৭৬৩। তিনি যুদ্ধের পূর্বাভাস পেয়ে বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, উপরোক্ত অফিসাররা এই সিদ্ধান্তের খবর জানতে পেরে তাকে ২৪শে মার্চ রাতে বগুড়া সেনানিবাস বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান পাটিয়ে দেয়া হয়। সাড়ে নয় মাস যুদ্ধ হল তার কোন হুদীস নেই, যুদ্ধ শেষ হলো তার কোন হুদীস নেই, শেষ পর্যন্তও তার কোন হুদীস নেই বা খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। গর্ভধারনী বিধবা মা জাহেদা খাতুন পুত্র শোকে কান্নাকাটি করতে করতে বেহালার তারের মতো শুকিয়ে তিনিও কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন।
স্মৃতি-৮: তৎকালীন সময়ে স্থলযোগে মানুষ চলাচল করা বা মালামাল আনা নেয়া কম হত। কারণ রাস্তাঘাট ছিল না বললেই চলে। তাই মানুষ চলাচল বা মালামাল আনা নেয়া করিত বেশির ভাগ নৌকার বাহনে, নদীপথে। আমাদের এলাকায় যাত্রী নৌকাকে বলা হতো গয়না, আর মালামাল আনা নেয়ার নৌকাকে বলা হতো পানশি নৌকা। আমাদের তিনটি পানশি নৌকা ছিল, দুটি নৌকা ভাড়া দেয়া হত আর একটি নৌকা আমার বাবা ভাগিদার লোক নিয়ে চালাতেন। ১৯৭১ এর যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, ভৈরব বাজার গিয়েছিলেন মাল আনার জন্য। কোন এক কারণে সময় লাগল এক মাসেরও বেশি,বিশেষ করে হাতে বেয়ে পাল তোলা নৌকা আর গুলাগুলি তো আছেই। ভৈরব যাওয়ার আগে বাড়িতে আমার মায়ের কাছে বলেছিলেন ব্যবসা তো সারাজীবন করেছি, এই ক্ষেপটা দিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতে চলে যাব। তারপর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করব। আমাদের বাড়িতে কান্নার রুল বয়ে গেছে। আমার দাদা ছামির উদ্দিন সাহেব কেঁদে কেঁদে বলছেন আমার বড় ছেলে আবুল হোসেন নৌকা নিয়ে গেল, এক মাসেরও বেশি। এখনও আসে না ব্যাপার কি? হঠাৎ একদিন বাবার ফুফাত ভাই গোলাপ মিয়া আনুমানিক সকাল ১০ টায় দৌড়ে এসে দাদাকে লক্ষ্য করে বলছে বড় মামা, বড় মামা ভাইসাব বাজারের গাটে আইসা নৌকা লাগাইছেন, আপনেরা কান্না-কাটি করবেন না। ফকিরের বাজার আমাদের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁেট পাঁচ মিনিটের রাস্তা। আমরা খুঁশিতে আত্মহারা হয়ে ভাই-বোন সবাই দৌড়াদৌড়ি করে নদীর ঘাটে নৌকার কাছে গেলাম। বাবা আমরা সবাইকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেনও আমাকে কুলে নিয়ে চুমো খেতে শুরু করলেন। নৌকায় গিয়ে দেখলাম ডিম রান্না করেছেন। বাবা আমাদেরকে খেতে দিলেন। এই মুহূর্তে রশি বাধাঁ দুই লাশ এসে বাজল নৌকার চারি বৈঠাতে। এই মুহূর্তে বাবা দাউ দিয়ে রশিটা কেটে দিলেন, লাশ নদীতে ভেঁসে গেল আমরা সবাই অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এই মুহূর্তে রেডিও তে ঘোষণা দিচ্ছে “জয় বাংলা, জয় বাংলা” দেশ স্বাধীন হয়েছে। এই খবর শুনে সব মানুষ খুশিতে “জয় বাংলা, জয় বাংলা” শ্লোগানে সেদিন আনন্দ মিছিল করেছে। লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক