নেত্রকোণা-সুনামগঞ্জ হাওরাঞ্চলে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে-পরিকল্পনামন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি: বিশেষ প্রতিনিধি: পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছে, ‘হাওর এলাকার বাউলরা সংস্কৃতির বৈশিষ্ট পুরোধা। তাঁরা আমাদের জন্য বিশাল ভা-ার রেখে গেছেন। প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাউলদের নিয়ে ভাবেন, চিন্তা করেন। শুধু বাউল নয়, লোকসংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির চর্চা করার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে আছেন। আমরা যারা তাঁর সঙ্গে কাজ করি তিনি আমাদেরকে বলেন বাংলাদেশের মূলে যান, গভীরে যান। আমরা প্রায় বিভ্রান্ত জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমরা আমাদের আত্মপরিচয় জানিনা। আমরা আমাদের নিজের পরিচয়ে গর্ববোধ করিনা। ধার করা পরিচয় দিয়ে কোন ভালো কিছু করা সম্ভব নয়। এই সত্যটা অনুধাবন করার জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বাঙালির বিকাশের আন্দোলনের এই মুহুর্তে তিনি প্রধান ব্যক্তি শেখ হাসিনা এই বার্তাটি আমাদেরকে বার বার দেন।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জের আদর্শনগরে শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বাউল সাধক উকিল মুন্সি স্মারণে বাউল উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, আমরা অন্য কোন জাতি বা অন্য কোন ভাষা চিন্তা কারো উপর চাপাবো না। আমাদের ওপর অনেকে চাপিয়েছে, অত্যাচার করিয়েছে, শাসন করিয়েছে, শোষণ করেছে, লুণ্ঠন করেছে, তাদের প্রতি আমাদের কোন ক্ষোভ নেই। ইতিহাস চলে গেছে। ইতিহাসকে আমরা পরিবর্তন করতে পারবো না। তবে এখনকার ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস। সব কিছুই বাঙালিত্ব। এটা মনে রাখতে হবে। মন্ত্রী আরো বলেন, পৃথিবীর যে কোন দেশের সংস্কৃতি তার নিজস্ব পরিচয় বহন করে। আমাদের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধতম। বিশেষ করে এদেশের হাওর জনপদের সংস্কৃতি বাঙালির চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের রাধারমন, হাসনরাজা, শাহ আব্দুল করিম, উকিল মুন্সিরা আমাদের অহংকার। মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওর জনপদের সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট উপলব্ধি করে হাওর অঞ্চলের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নানামুখি কাজ করছেন। তাঁর নির্দেশেই সুনামগঞ্জ-নেত্রকোণা হাওর এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণ করার পরিকল্পনা করছে সরকার। বর্তমান সরকারের সময়েই তা বাস্তবায়ন করা হবে। ছাতক পর্যন্ত রেল আছে। তা থেকে সুনামগঞ্জে রেললাইন হবে। পযায়ক্রমে তা ঘুরে নেত্রকোণাতে যুক্ত হবে। মানুষ ট্রেনে বসে হাওর উপলব্ধি করবে। মন্ত্রী বলেন, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল হচ্ছে বোরো ধান উৎপাদনের ভা-ার। আমরা চাইলেই এখানে একটি এগ্রিকালচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (এটিআই) স্থাপন করে ফেলতে পারি। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই সারা বাংলাদেশ উলটপালট করে আমারা নতুন বাংলাদেশ গড়বো। আধুনিক বাংলাদেশ গড়বে। চিরদিন আমরা হেলার শিকার হবো না।
এ সময় মন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা আমাদেরকে নিয়ে চিন্তা করেন। খাদ্য জোগান, ভালোবাসেন। সুতরাং তাঁর সঙ্গে থাকবো নাকি দু চারজন প-িত রাতের আধারে কফি খেয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন আমাদের সরকারের সমন্ধে। তাঁদের সঙ্গে থাকবো? কোনটা আগে জরুরি-আগে তো ভাত, পোশাক, স্কুল, হাসপাতাল পরে ফেসানেবল সুশাসন বা অন্যান্য বিষয়। আমি তাঁদেরকে বলি আপনা ঢাকায় বাস করেন অনেক জ্ঞানী আপনাদের সালাম, সালাম, সালাম। আমরা কৃষক মানুষ মাছ ধরি, মাটি কাটি, নৌকায় বাদাম তুলি আমাদেরকে আমাদের মতো কাজ করতে দিন, থাকতে দিন। আমাদের বন্ধু শেখ হাসিনা। আমরা তাঁর সঙ্গে থাকবো।
বাউল উৎসব উদযাপন কমিটি ও শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয় যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে সভাপত্বি করেন প্রধানমন্ত্রীর কাযালয়ের সচিব ও শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সাজ্জাদুল হাসান। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছাড়াও বক্তব্য দেন, স্থানীয় সাংসদ রেবেকা মমিন, অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার, জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম, পুলিশ সুপার জয়দেব চৌধুরী প্রমুখ।


প্রাবন্ধিক যতীন সরকার বলেন, উকিল মুন্সি যে অঞ্চল থেকে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠেছেন, সঙ্গীত সাধনা করেছেন-সেই অঞ্চলটি দেশের অনেক অঞ্চল থেকেই পৃথক। এটি ময়মনসিংহ গীতিকার অঞ্চল। এই অঞ্চলটির একটি বৈশিষ্ট হলো এখানে রিলিজিয়াস ফান্ডামেন্টালিজম কোন জায়গা পায়নি। এখানের মানুষ এত বেশি অসাম্প্রদায়িক, আমাদের যে গীতিকা সাহিত্য সেই গীতিকা সাহিত্যের মধ্যেই অসাম্প্রদায়িক চৈতন্যের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। সেখানে বলা হয়েছে- ‘হিন্দু আর মুসলমান একই বিন্দের দড়ি, কেহ বলে আল্লা আর কেহ বলে হরি। বিসমিল্লাহ আর শ্রীবিষ্ণু একই দেয়ান, দুহাত করিয়া দেখি রাম-রহিমান।’ এখানে হিন্দু-মুসলমান বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন দিন কোন বিভেদ সৃষ্টি হয় নাই। এর চেয়ে বড় কথা, আমরা জানি যারা গান বাজনা করেন তাঁরা সাধারণত ধর্মীয় আসরে স্থান পাননা। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মবিদরা গান-বাজনাকে নিরুৎসাহীত করেন। কোন কোন স্থানে তাঁদের অত্যাচার করেন। ভারতের লেখক গবেষক শক্তিনাথ ঝা জানিয়েছেন মেদিনীপুরে বাউলদের মাথার ঝুটি কেটে দেওয়া হয়, অত্যাচার করা হয়। আমাদের লালন ফকিররে কুষ্টিয়াতেও সে-রকম ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমরা অত্যান্ত গর্বের সঙ্গে বলতে পারি আমরা এমন এক এলাকার লোক যেখানে এরকম কথা কেউ চিন্তাতেও আনতে পারে না। তিনি আরো বলেন, মুন্সি কথাটার অর্থ যদিও মসিজীবী বা কেরানি ইত্যাদি বোঝালেও আমাদের এলাকায় মুন্সি বলতে বুঝি যারা মৌলবী বা মসজিদে ধর্মীয় কাজে ইমামতি করেন। তাই মুন্সি হোক মৌলবী হোক কোন এলাকাতে মুন্সিরা গান গাইতে পারে এবং গায়ক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যান এটি কোন এলাকায় নাই। এটি আমাদের এলাকার বৈশিষ্ট। এখানেই উকিল মুন্সির মতো মানুষের জন্ম হওয়া সম্ভব।
উকিল মুন্সিকে বিরহী বাউল বলা হয়। কারণ তাঁর জীবন কেটেছে বিরহের মধ্যে। ১৮৮৫ সালে তিনি নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলার নুরপুর বোয়ালি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম আব্দুল হক আকন্দ। ১০ বছর বয়সে তাঁর বাবার মৃত্যু হলে মার অন্যত্র বিয়ে হয়। সেখানে তাঁকে নিয়ে আসা হলেও থাকতে পারেনি। এর পর থেকেই তাঁর ভেতরে একটি বিরহের জ্বালা সৃষ্টি হয়ে যায়। তিনি মোহনগঞ্জের জালালপুর গ্রামে হামিদা খাতুন ওরফে লাবুসের মা নামে মেয়ের প্রেমে পড়েন। উভয়ের পরিবার তাঁদের এই মেনে না নেওয়ায় সেখান থেকে তাঁর অনেক গানের উপাদান তৈরি হয়।
উৎসবের দ্বিতীয় পর্বে বিকেলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, শেখ হাসিনা বিশ্বাবিদ্যালয়ের উপাচায অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কবি ও প্রাবন্ধিক তরুণ শিকদার প্রমুখ আলোচনা করেন। রাতে প্রখ্যাত বাউল শিল্পী মমতাজ বেগমসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিল্পীরা বাউল সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।