
‘মানবজাতির সভ্যতার ক্রমবিকাশের সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস জানতে হলে তোমাকে যেতে হবে কবিতার কাছে। POETRY IS NEARER TO VITAL TRUTH THAN HISTORY (ইতিহাস নহে, জীবনসম্পৃক্ত সত্যের নিকটবর্তী হলো কবিতা) ..মহামতি প্লেটো।
মানবতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ ষাট দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের কবিগণের অন্যতম কবি ও চিত্রশিল্পী কবি নির্মলেন্দু গুণ। (জন্ম: ২১ জনু, ১৯৪৫ইং ৭ আষাঢ়, ১৩৫২ বঙ্গাব্দ, কাশবন, বারহাট্টা, নেত্রকোণা)। তিনি বাংলাদেশের পাঠকনন্দিত কবি। তিনি শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। তাঁর অগণিত কবিতা মানুষের মুখে মুখে। তিনি শ্রেণীসংগ্রাম, স্বৈরাচার-বিরোধিতা পাশাপাশি তিনি প্রচুর প্রেমের কবিতাও লিখেছেন। লিখেছেন, ‘আমি যেখানেই হাত রাখি তোমার শরীর’-এর মতো শিহরণ জাগানো পঙ্ক্তি, কিংবা ‘খোঁপার মতো কোনো ফুলদানী নেই’-এর মতো মুগ্ধকর চরণ। এছাড়াও ছড়া কবিতা, গল্প-প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী সাহিত্যের প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি বিচরণ করেছেন। ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লিখিত ‘হুলিয়া’ থেকে ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কবিতা পর্যন্ত ধারাবাহিকতায় তিনি একজন রাজনীতি সচেতন কবি হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত।
জন্মভূমি ও জন্মভূমির মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও সুচিন্তিত দায়বদ্ধতা থেকে তিনি স্বদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত কবিতায় বিন্যস্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে কবি শামসুর রাহমান বলেছেন, ‘ষাট দশকে নির্মলেন্দু গুণের আবির্ভাব। তখন তাঁর কবিতা ছিল আত্নকেন্দ্রিক, কিছুটা বিষয়বাসী। কিন্তু দেশে ও দশের প্রতি তাঁর অসামান্য মমত্ববোধ তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিলো এমন সব কবিতা, যেগুলো রৌদ্রাভিসারী, খোলামাঠের হাওয়ার মতো দুরন্ত, উদ্দাম। তাঁর কবিতা ক্রমশ হয়ে উঠলো রাজনীতি সচেতন। মাঝে মধ্যে অন্য ধরনের কবিতা লিখলেও মূলতঃ রাজনীতিকেই তিনি কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করলেন, তবে কাব্যধর্মকে বিসর্জন দিয়ে নয়’। স্বাধীনচেতা এই কবি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যোগ দিয়েছিলেন, তখন তিনি প্রেরণায় জলে উঠে লিখেছিলেন, ‘আগ্নেয়াস্ত্রের মত সাড়া জাগানো কবিতা। তখন এ কবিতা লেখা সম্ভব ছিলো শুধুমাত্র একজন সাহসী খাঁটি বাঙালি কবির পক্ষে। দুর্লভ এই সাহসিকতা। এই সাহসিকতা ও জনসাধারণের আশা-আকাঙ্খার সঙ্গে একাত্ববোধই নির্মলেন্দু গুণকে আমাদের জনপ্রিয়তম কবি করে তুলেছে।’
কবি নির্মলেন্দু গুণ কাব্যের বাইরেও একজন সমাজ সচেতন মানুষ। তিনি মনে করেন, ‘সামাজিক কাজ, এটাতো কবির পক্ষেরই কাজ’। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা পদকের প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে নিজ জেলা নেত্রকোণায় তৈরি করেছেন ‘কবিতাকুঞ্জ’ নামে বিশ্বের সকল ভাষার একটি সংগ্রহশালা ও পাঠ চর্চাকেন্দ্র। এই পাঠ চর্চাকেন্দ্র গড়ে তোলায় আনন্দিত কবি, সাহিত্যিক ও কবিতা প্রেমীরা। এছাড়াও বারহাট্টায় নিজ গ্রামে তৈরি করেছেন ‘কাশবন’। সেখানে সেরা চারজন বাঙালির ভাস্কর্য রয়েছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং রয়েছে বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন এর ভাস্কর্য। তাছাড়া রয়েছে-কাশবন বিদ্যানিকেতন (উচ্চ বিদ্যালয়), রামসুন্দর পাঠাগার, বীরচরণ মঞ্চ, সারদা-বাসুদেব চিত্রশালা (আর্টস্কুল) শৈলজা সঙ্গীত ভুবন (গানের স্কুল), শহীদ মিনার ইত্যাদি।
বাংলাভাষা ও কবিতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃত স্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে, স্বাধীনতা পুরস্কার একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কার, শান্তিনিকেতন সম্মাননা, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, উইলিয়াম কেরী পুরস্কার, আলাওল পুরস্কার, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন পদক এবং বঙ্গবন্ধু পদকসহ অগণিত পুরস্কার ।
কবির প্রকাশিত গ্রন্থসমগ্র: গ্রন্থপঞ্জি: প্রেমাংশুর রক্ত চাই ১৯৭০, না প্রেমিক না বিপ্লবী ১৯৭২, কবিতা, অমীমাংসিত রমণী ১৯৭৩, দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী ১৯৭৪, চৈত্রের ভালোবাসা ১৯৭৫, ও বন্ধু আমার ১৯৭৫, আনন্দ কুসুম ১৯৭৬, বাংলার মাটি বাংলার জল ১৯৭৮, তার আগে চাই সমাজতন্ত্র ১৯৭৯, চাষাভুষার কাব্য ১৯৮১, অচল পদাবলী ১৯৮২, পৃথিবী জোড়া গান ১৯৮২, দুর হ দুঃশাসন ১৯৮৩, প্রথম দিনের সূর্য ১৯৮৪, ইসক্রা ১৯৮৪, শান্তির ডিক্রি ১৯৮৪, নেই কেন সেই পাখি ১৯৮৫, নিরঞ্জনের পৃথিবীর ১৯৮৬, চিরকালের বাঁশি ১৯৮৬, দুঃখ করো না, বাঁচো ১৯৮৭, যখন আমি বুকের পাঁজর খুলে দাঁড়াই ১৯৮৯, ধাবমান হরিণের দ্যুতি ১৯৯২, সোনার কুঠার ১৯৮০, রক্ত আর ফুলগুলি ১৯৮৩, অনন্ত বরফবীথি ১৯৯৩, আনন্দ উদ্যান ১৯৯৫, পঞ্চ সহ¯্র বর্ষ ১৯৯৫, প্রিয় নারী, হারানো কবিতা ১৯৯৬, শিয়রে বাংলাদেশ ১৯৯৮, ইয়াহিয়া কাল ১৯৯৮, আমি সময়কে জন্মাতে দেখেছি ২০০০, বাৎস্যায়ন ২০০০, মুঠোফোনের কাব্য ১-২০০৩, চিরঅনাবৃতা, হে নগ্নতমা ২০০৫, নিশিকাব্য ২০০৬, নির্বাচিতা ১৯৮৩, কাব্যসমগ্র ১-১৯৯২, কাব্যসমগ্র ২-১৯৯৩, কাব্যসমগ্র ৩-২০০৫, রাজনৈতিক কবিতা ১৯৮৯, মুঠোফোনের কাব্য ২-২০০৪, প্রেমের কবিতা ১৯৮৭, প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতাসমগ্র ১৯৯৮, ঝবষবপঃবফ চড়বস, নির্বাচিত ১০০ কবিতা ২০০৪, মুজিব ২০০১, বসন্ত ২০০১, বর্ষা ২০০১, মুজিব, লেনিন ইন্দিরা ২০০১, আকাশ ২০০১, ১০০ রাজনৈতিক কবিতা ২০০৮, পথে পথে পাথর ২০০৭, কামকানন ২০০৭, জন্ম দিও বঙ্গে ২০০৯, একুশের একুশ কবিতা ২০০৯, কাব্যনাটিকা সমুচ্চয় ২০০৯, মুঠোফোনের কাব্যসমগ্র ২০০৭, রাজনৈতিক কবিতা ২০১৪, কাব্যসমগ্র ৪-২০১২, রক্ষা করো, হে ভৈরব ২০১৪, কবিতাকুঞ্জ ২০১৯।
গদ্যগ্রন্থ: আমার ছেলেবেলা ১৯৮৮, নির্গুনের জার্নাল ১৯৮৭, ভিয়েতনাম ও কাম্পুচিয়ার স্মৃতি ১৯৯৩, গীনসবার্গের সঙ্গে ১৯৯৪, আমেরিকায় জুয়াখেলার স্মৃতি ও অন্যান্য ১৯৯৫, আমার কন্ঠস্বর ১৯৯৫, রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫। ১৯৯৭, নির্গুনের জার্নাল ১৯৯৬। ১৯৯৫, সেনাকুঞ্জে কিছুক্ষণ ১৯৯৭, পুনশ্চ জাপান যাত্রী ২০১০, ভুবন ভ্রমিয়া শেষে ২০০৫, দিল্লি ২০০৭, রচনা ২০০০।২০০১, নির্বাচিত ভাবনা ২০০২, শক্তিস্মৃতি ও অন্যান্য ২০০৩, ভ্রমি দেশে দেশে ২০০৫, অন্তর্জাল ২০০৫, বাঙালির জন্মদিন ও অন্যান্য প্রবন্ধ ২০০৬, ভ্রমণসমগ্র ২০০৬, গদ্যসমগ্র ১।১৯৯৭, গদ্যসমগ্র ২।১৯৯৭ গদ্যসমগ্র ৩।১৯৯৭, হিটলারের পুনর্জন্ম ও অন্যান্য ২০০১, আত্নকথা ১৯৭১’ ২০০৮, এবং প্যারিস ২০০৯, পৃথিবী গদ্যময় ২০০৮, ক্রিকেটসমগ্র ২০১৩, ছড়াবড়া ২০০৯, সাক্ষাৎকারসমগ্র ২০১০, অবন্ধ প্রবন্ধ যত ২০১০, রঙের জাতক ২০১০, গদ্যসমগ্র ৪। ২০১২, নির্গুণের মুখপঞ্জি ও সুইডেনের গল্প ২০১৪, নির্গুণের মুখপঞ্জি ও পাঁজর খোলার গল্প ২০১৫, গদ্যসমগ্র ৫। ২০১৫, গদ্যসমগ্র ৬। ২০১৬
কবি নির্মলেন্দু গুণকে নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ: নির্মলেন্দু গুণ উজান তরীর মাঝি-মজিবর রহমান ১৯৯৭, নির্মলেন্দু গুণের কাব্যে সমজা ও স্বদেশ ভাবনা ড. ফাল্গুনী রানী চক্রবর্তী ২০০৮, মহুয়া নির্মলেন্দু গুণ সংখ্যা ২০০৮ (হামিদুল আলম সখা ও রামশংকর দেবনাথ সম্পাদিত), কারুভাষ (কলকাতা) রামশংকর দেবনাথ সম্পাদিত (সম্পাদক মানসী কীর্তনিয়া), কাশবন নির্মলেন্দু গুণ বিশেষ সংখ্যা (সম্পাদক মিন্টু হক)
ভ্রমণ করেছেন, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভিয়েতনাম, কাম্পুচিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নেপাল, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেন।
‘নির্জন নীলাকাশতলে, মগরা নদীতীরে, যখন সন্ধ্যার আলো জলে, তখন কবিতাকুঞ্জ কবিতার কথা বলে। বিশ্ববীণায় বাজে মহাজীবনের গান। বিচ্ছিন্ন মানবজাতি কবিতাকুঞ্জে বসে শোনে মহামিলনের ঐকতান’ (কবিতাকুঞ্জ, র্র্র্র্নিগুণ)। কবির নিজ গ্রাম ‘কাশবন’-এর কাজ সমাপ্তির পর বিশ^ব্যাপী সমাদৃত হবে এবং কবি, সাহিত্যিক, কবিতাপ্রেমীদের পাঠ চর্চায় ও গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হবে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ভাবনা থেকেই কবিতাকুঞ্জের সৃষ্টি।
কবি বলেন, শুরুতেই কবিতাকুঞ্জের ধারণাটা আমার মাথায় আসেনি। নির্মলেন্দু গুণ গবেষণা কেন্দ্র করার কথা ভেবেছিলাম। তখন কবি এনামুল হক পলাশ ও আমার মামাত ভাই রুপন দত্তর তত্ত্বাবধানে কাজটা শুরু করি। মূল ভবনটি তৈরি হওয়ার পর আমার মাথায় কবিতাকুঞ্জ (বিশ্বকবিতার বাসগৃহ) সারা বিশে^র সকল ভাষার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কাব্যগুলোকে একত্রিত করার ধারণাটি আসে। কবিতা নিয়ে এরকম কোনো প্রতিষ্ঠান বিশ্বে কোথাও নেই। আমি খুব আনন্দ ও উত্তেজনাবোধ করি এরকম একটা খুব বড়-চিন্তা আমার মাথায় আসায়। আমি খুব খুশি হই। লজ্জিতবোধ করি আমার আত্মকেন্দ্রিক পূর্ব চিন্তাটির কথা ভেবে। কবিতাকুঞ্জের ধারণাটি আমাকে এক উচ্চতর ভাবনাজগতে নিয়ে যায়। আমি একটা নতুন স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হই, যার ফসল হলো আজকের কবিতাকুঞ্জ।
কবিতাকুঞ্জের ভূমি অধিগ্রহণ: ০৩ নভেম্বর, ২০১৫ তারিখের ৩১.০০.০০০০.০৪২.৪১.১৬৪.১৫-১৪৪ নং স্মারকে তফসিল বর্ণিত খাস অকৃষি জমি বসতবাড়ি নির্মাণ-এর কাজের জন্য জেলা প্রশাসক ড. মুশফিকুর রহমান-এর সহযোগিতায় ভূমি মন্ত্রণালয় হতে ৮ শতক জায়গা দীর্ঘ মেয়াদি লিজ নিয়ে তফসিলভুক্ত জমির মোট সেলামী ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা প্রদান করে কবি নেত্রকোণার পৌর শহরের মালনী এলাকায় মগড়া নদীর বাঁকে গড়ে তুলেছেন কবি, সাহিত্যিকদের পাঠ চর্চাকেন্দ্র ‘কবিতাকুঞ্জ’।
উদ্বোধন: কবি মনে করেন, ‘সমুদ্র সৈকত, পাহাড়-পবর্তের যেমন উদ্বোধন হয়না, তেমনি কবিতাকুঞ্জেরও উদ্বোধন হবে না’। তবে কবির পরামর্শক্রমে ডিসেম্বর ২০১৬ সালে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার রায়ের উদ্যোগে এবং কবিতাকুঞ্জের চারজন কর্মী যথাক্রমে এনামুল হক পলাশ, দীপক সরকার, রূপন দত্ত, শামীম আহমেদ এর সমন্বয়ে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবিভক্ত পাঠক-পাঠিকা ও জনসাধারণের ব্যাপক উপস্থিতির মাধ্যমে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় বিশ^কবিতার বাসগৃহ ‘কবিতাকুঞ্জ’।
কুঞ্জঘাট কবি, সাহিত্যিক ও পাঠকদের অবসর কাটানোর জন্য রয়েছে মনোমুগ্ধকর কুঞ্জঘাট। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার রায়ের তত্ত্বাবধানে এবং জেলা পরিষদ নেত্রকোণা অর্থায়নে ১৫,০০০,০০ (পনের লক্ষ) টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় কুঞ্জঘাট। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে দর্শণার্থীরা ছুটে আসছেন কুঞ্জঘাটে। এঘাটে মালনী এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ প্রতিদিন স্থান করছেন এবং কুঞ্জঘাটে বসেই দর্শনার্থীরা উপভোগ করছেন গ্রীষ্ম-বর্ষাতে ছোট ছোট ঢেউয়ের নান্দনিকতা এবং শীত-বসন্তে মগড়া নদীর দু’পাড়ের সৌন্দর্য।
সংগ্রহ: বিশ্বের প্রায় ৮৫টি ভাষার ১,৭০০টি কাব্যগ্রন্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। কবিতাকুঞ্জের ভেতরে কবির তৈরি চিত্রশিল্পসহ বিখ্যাত কবিদের প্রায় ৫৭টি ছবি সারি বেঁধে সাজানো রয়েছে। একটি কর্ণারে সংরক্ষিত রয়েছে কবির বই, কবিকে নিয়ে লেখা বই, উৎসর্গ করা বই, পুরস্কার পারিবারিক ও কবির ব্যক্তিগত কিছু ছবি । এ ছাড়াও রয়েছে কবিতাকুঞ্জের সামনে এবং পেছনে পরিবেশ বান্ধব কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া এবং শেফালি ফুলের গাছ।
আবাসিক ব্যবস্থা: দেশের দূর-দূরান্ত এবং দেশের বাইরে থেকে আসা কবি, সাহিত্যিক ও পাঠকদের রাত্রিযাপন করার জন্য রয়েছে মনোরম ও সুন্দর ব্যবস্থা, রয়েছে কুঞ্জঘাট সংলগ্ন মগড়া ও সোমেরী নামক দুটি অতিথিশালা।
কবিতাকুঞ্জের ভবিষ্যত ভাবনা: কবিতাকুঞ্জের ভবিষ্যত নিয়ে কবি বলেন, আমার বিশ্বাস, বিশ্বকবিতার বাসগৃহ, নেত্রকোণার মালনীতে মগরা নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত কবিতাকুঞ্জ থেকে একসময় কবিতা নিয়ে গবেষণা করার জন্য পিএইচডি (PHD) ডিগ্রি প্রদান করা হবে। শুরুতে আমার এ বিশ্বাস ছিলনা। কিন্তু কবিতাকুঞ্জের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে নেত্রকোণায় মালনী সংলগ্ন রাজুর বাজারে শেখ হাসিনা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার কাজ যখন শুরু হয়ে গিয়েছে, যখন প্রীতিভাজন ড. রফিকউল্লাহ খানকে এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে এবং একনেক থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পাশ করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো তৈরির জন্য। তখন কবিতাকুঞ্জকে নিয়ে আমার এই ভাবনাটিকে আকাশ কুসুম কল্পনা বলে মনে হচ্ছেনা। শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে কবিতাকুঞ্জ নিয়ে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। তিনি (ড. রফিকউল্লাহ খান) আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন যে, ভবিষ্যতে বাংলা কবিতা ও বিশ্বকবিতা নিয়ে গবেষণা করার জন্য শে-হা-বি কবিতাকুঞ্জকে অধিগ্রহণ করতে পারবে এবং বিশ্বকাব্যকে (WORLD POETRY) আর্টিফ্যাকাল্টির অন্তর্ভুক্ত একটা বিষয় হিসেবে শে-হা-বিতে চালু করা যেতে পারবে। এতে একে অন্যের গৌরব বৃদ্ধি করতে পারবে। সারা বিশ্বের সর্ব কালের শ্রেষ্ঠ কাব্যসম্ভারকে কবিতাকুঞ্জে একত্রিত করার যে প্রয়াস চলছে- আগামী বছর দুয়েকের মধ্যেই সেই কাজ (জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রের কাব্য সম্পদ সংগ্রহ করা) সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে আমরা ধারণা করছি। আমি বিশ্বাস করি এক দিন কবিতাকুঞ্জ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে বিবেচিত হবে। বিবেচিত হবে এজন্য যে, কবিতা নিয়ে গবেষণা করার মতো এইরূপ কোনো প্রতিষ্ঠান পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। আপাতত বাংলা ভাষার সকল গুরুত্বপূর্ণ কাব্যসহ বিশ্বের ৮০টি দেশের কবিতাকুঞ্জে সংগৃহিত হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ২০০ দেশের ৪০০ ভাষার কবিতা। বিভিন্ন ভাষায় অভিধান এবং ব্যাকরণগ্রন্থও আমরা সংগ্রহ করছি, করবো। কাব্যচর্চার জন্য ভাষাচর্চাও আবশ্যিক বলে আমরা মনে করি। ফেইসবুক পেজে কবিতাকুঞ্জের গ্রন্থ-তালিকার আপডেট নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে। আগ্রহী কাব্য-পাঠক ও গবেষকরা সেটি দেখে নিতে পারেন।
পাঠকদের মন্তব্য খাতা থেকে- দেশ বরেণ্য কবি নেত্রকোণার কৃতি সন্তান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কবিতাকুঞ্জ ঘুরে দেখলাম। কবির প্রত্যাশা পৃথিবীর শেষ্ঠ কবিদের কবিতার বই এখানে সংগ্রহ করা হবে। পাঠকদের উৎসাহ হবে, এখানে পড়তে আসবে। এ ধরনের উদ্যোগ কোথাও আছে কি না আমার জানা নাই। আমাদের অহংকার বাংলাদেশের বরেণ্য কবি প্রিয় নির্মলেন্দু গুণ দাদার এ উদ্যোগ সফল হোক। এ প্রত্যাশা রইল (সাজ্জাদুল হাসান, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়)।
একজন কবির সৃজনশীল উদ্ভাবনার অনন্য দৃষ্টান্ত ‘কবিতাকুঞ্জ’। আমার প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান আমার কাছে এক অনুস্মরণীয় আদর্শ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘কবিতাকুঞ্জ’ ও কেবল আমার কাছে নয়, প্রত্যেক লেখক শিল্পীর জন্যই আদর্শরূপ হতে পারে। কবির দীর্ঘ জীবন কামনা করি। ( রফিকউল্লাহ খান, ভিসি, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোণা)।
বড় কিছু করার শর্তে আমরা ছোট কিছু করিনা। আমরা অবোধের মত জীবন অতিবাহিত করি তাই- ছোটকে বড় করে তোলার ক্সধর্য্য-সাহস কিছুই দেখাতে অক্ষম। গুণ’দা ভিন্ন ধাতুতে গড়া মানুষ। তিনি জানেন কি করে স্বপড়ব গড়ে তোলা যায়। আবৃত্তি শিল্পী, শিল্পের আশ্রমের সন্ধান পেলে যে সুখ অনুভব করে আমারও তেমন বেধি হচ্ছে। (কবি হাসান আল আব্দুল্লাহ, আমেরিকা প্রবাসী)।
সবুজ শ্যামল এই বাংলায়, ভালোবেসে পেতেছি এই বুক। আজ এই বলে পরিচয় হোক, আমি তোমাদেরই লোক। শুভহোক কবিতাকুঞ্জের পথচলা। কামাল হোসাইন (সাংবাদিক)
কবিতার মতো অনর্থকরী ফসল ক’জনই বা চাষ করতে চায়। সেখানে কবি নির্মলেন্দু গুণ কোনো নগদ প্রাপ্তি ছাড়াই আস্ত একটি জীবন খরচ করে দিয়েছেন কবিতা-চাষে। এর ফসল তিনি একাই ভোগ করছেন না, বরং ফসলের ন্যায্য হিস্যা তিনি বিলিয়ে দিচ্ছেন কবিতাপ্রেমী সকলের মাঝে। এরই অংশ হিসেবে গুণ প্রতিষ্ঠা করলেন কবিতাকুঞ্জ। কবিতাকুঞ্জের আলমারিগুলো ভরে উঠুক ভিন্নসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সব কাব্যগ্রন্থে, কবিতাকুঞ্জ মাতোয়ারা হোক কবিতাপ্রেমীদের পদচারণায়। (আখতারুজ্জামান আজাদ)
আজ হেমন্তের রৌদ্রজ্জ্বল সু-প্রভাতে বহুদিনের কাঙ্খিত ‘কবিতাকুঞ্জ’ পরিদর্শনে আমরা উভয়ে এসছি। একত্রে এতসব মহাকবি ও কবিদের দর্শনে ভীষণ আনন্দ অনুভব করছি। ইতিপূর্বে এধরনের একত্রিভূত কবি সমাবেশ পরিদর্শন কোথাও হয় নাই। অশেষ শুভ-কামনা রইলো এই ‘কবিতাকুঞ্জ’ এর ভবিষ্যত নিয়ে, অধিকতর পরিকল্পনার চিন্তা মাথায় রেখে এহেন দর্শন শেষ করলাম। পরিশেষে এর উত্তরোত্তর শ্রী-বৃদ্ধি কামনা করি। (দিলীপ কুমার দাস ও ঝিল্লীকা গুণ চে․ধুরী দাস, ২৭, কে.এস. দাশ লেন, ওয়ারী, ঢাকা-১২০৪)।
শ্রদ্বেয় কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রতিষ্ঠিত কবিতাকুঞ্জ পরিদর্শন করলাম। আমি অত্যন্ত আনন্দিত এই কার্যক্রম দেখে, আমি মনে করি কবিতাকুঞ্জ নতুন প্রজন্ম তথা আমাদের সবাইকে সারাবিশে^র সাহিত্যের সাথে পরিচিত ঘটাবে। আমি কবিতাকুঞ্জের সফলতা কামনা করছি। শ্রদ্ধেয় কবিসহ সংশ্লিষ্ঠ সবার প্রতি আমার নিরন্তর শুভকামনা। (সজীব দত্ত, উপস্থাপক, বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা)।
কবি নির্মলেন্দু গুণ কবি হওয়ার যে আনন্দযজ্ঞে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন তরুণ বয়সে সেই আনন্দকেই তিনি বিশ্বকবিতার বাসগৃহ কবিতাকুঞ্জের মাধ্যমে কবিতাপ্রেমীদের মাঝে নতুন ছন্দে বিলিয়ে দিতে চান। তাই কবি আহ্বান করেন-
কাব্যশক্তি মহাশক্তি, বিধাতার দান,/ নরলোকে তিনি ধন্য, যিনি তাহা পান। /কাব্যরূপ কুঞ্জে বাস করে যেই জন, /প্রেমভাবে কাটে নিত্য তাহার জীবন। /বিশ^ময় যতো কাব্য, মহাকাব্য আছে, /আছে কাব্যশাস্ত্র-তত্ত্ব, পদাবলী-গান, /মানুষ রচেছে যতো কালের পুরাণ, /সবই এসে কবিতার কুঞ্জে মিলিয়াছে। /মানবিক চৈতন্যের বোধিবৃক্ষ তলে, /ধুয়ে ফেলে হিংসাদ্বেষ মগরার জলে-; /কবিতাকুঞ্জে ফিরে এসো বোন-ভাই, /বিশে^র সবারে আমি স্বাগত জানাই। লেখক: গ্রন্থাগারিক, কবিতাকুঞ্জ। মালনী, নেত্রকোণা।
[কবিতাকুঞ্জে আগত পাঠক এবং দর্শনার্থীদের জন্য সুসংবাদ; এখানে কবির ১০ খ- রচনাবলীসহ তার সকল গ্রন্থ ৪০% কমিশনে পাওয়া যাবে।]