
মুফতি মাহমূদ হাসান: আমার গ্রাম আমার ঠিকানা আমরা অনেকেই গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস করি। মানবিক প্রয়োজনে গ্রাম থেকে আমাদের শহরে থাকতে হয়। উচ্চ শিক্ষা ও চাকুরীর সুবাদে প্রিয় গ্রাম ছেড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমাদের বসবাস। কখনো ঢাকায়। আবার কখনো চট্রগ্রামে। কখনো বা বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেট। সরকারি ও বেসরকারি ফরমানে জীবিকার তাগিদে আমাদের ছুটে যেতে হয় প্রিয় গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে অপরিচিত নতুন ঠিকানায়। নিজের উজ্জল ভবিষ্যতের চিন্তায় ইট- পাথর ও ধূলাবালির শহরকে নিজেদের জীবনে আপন করে নিতে হয়। কিন্তু জীবনের এই ঘূর্ণিপাকে আমরা কি কখনো আমাদের গ্রামের কথা ভুলতে পারি! পারি কি কখনো জন্মভূমির অপরূপ দৃশ্য হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে। গ্রামের শৈশব ও ছোট বেলার ইতিহাস কখনো কেউ স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলতে পারেনা বিধায় আজকের লেখায় আমি আমার গ্রাম ও এলাকা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে চাই। মাতৃভূমির ভালোবাসার দাবীতে আজ আমি আমার অঞ্চল নিয়ে পাঠকের সামনে দুচারটি কথা পেশ করতে চাই। কারণ, নিজ এলাকার মুহাব্বতে আমি আগামীর স্বপ্ন দেখি। প্রিয় মাতৃভূমির ভালোবাসায় আমি অনেক দূর যেতে চাই।
নেত্রকোণা জেলার বারহাট্রা থানাধীন একটি অঞ্চলের নাম হল রায়পুর। রায়পুর নেত্রকোণা শহর থেকে আনুমানিক ১০ কেলোমিটার দূরে অবস্থিত। জেলা শহর থেকে রায়পুর ইউনিয়ন একটু দূরে হলেও জীবন্ত নদীর পাশ ঘেষে শতবছর আগে গড়ে ওঠেছে উক্ত ইউনিয়নের চল্লিশ কাহনীয়া গ্রাম। গ্রামের বাসিন্দাদের নাগরিক সুবিধার্থে বহুবছর যাবত কংশ নদীর তীরে জমজমাট চলছে ফকিরের বাজার। গ্রামে বসবাসকারীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রয়োজন পূরণ করার লক্ষে শত বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের ফকিরের বাজার। বাজারটি দৈর্ঘ্যপ্রস্থ মিলিয়ে উপশহরের মত। গ্রামঘেড়া বাজারের আশপাশে আছে গ্রামের অপরূপ দৃশ্য। আছে কূলহীন কালজয়ী নদী। নদীর বুকে গ্রাম ও বাজারের অস্তিত্ব যেন সমুদ্রজলে খুঁটিহীন ভাসমান রাজ প্রাসাদ। যেন নদীর বুকে মনোরম কোন উদ্যান। মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন ও তাদের শিক্ষার হার বৃদ্ধির করার লক্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের গ্রামে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংস্থা। আছে ফকিরের বাজার রায়পুর গ্রামে অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা ও মন্দির। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাজারের প্রাণকেন্দ্রে স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার স্থায়ী সেন্টার। আমাদের গ্রামে হিন্দুদের সংখ্যা কম থাকলেও হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলেমিশে থাকে। গ্রামীনবাজারের মূল বাসিন্দাদের অধিকাংশ অমুসলিম হলেও বাজার ছাড়া অন্য কোথাও তাদের তেমন জনবসতি নেই। বাংলাদেশের বর্ডারে এই এলাকায় কখনো ধর্মীয় দাংগা-হাঙ্গামা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের এলাকায় ধর্মকে পুঁজি করে কখনো কেউ রাজনীতি করেছে বলেও আমার মনে হয়না। বরং ধর্মীয় বিষয়াদি বাদে নিজ এলাকায় হিন্দু- মুসলিমের বসবাস সারা দেশের সব জাতির জন্য মডেল হতে পারে। রাজনৈতিক বৈরী আবহাওয়ার ছুঁয়া আমার এলাকায় আগে না থাকলেও ইদানিং তা ভালই চলছে।
ফকিরের বাজার সংলগ্ন খাশপাড়া, চড়পাড়া, রামপুর ও বেতাটি ফেরীঘাটও দেখতে দারুণ। প্রত্যেকটা এলাকাই নদীমাতৃক খাল-বিল পরিবেষ্টিত। সবুজ- শ্যামল প্রাকৃতিক পরিবেশে গ্রামের চিত্র কার না দেখতে ভাল লাগে! নদীর তীরে দাঁড়িয়ে পরন্ত বিকালে গ্রাম বাংলার মনোরম দৃশ্যে কার না মন ব্যাকুল হয়! কে না চায় নদীর হিমেল বাতাসে নিজের দেহ- মন প্রশান্ত করতে! বিকেল বেলায় নদীর পাশে বসে আড্ডা দিতে কার না মন চায়! কে না চায় গোধূলি বেলায় নদীর বুকে নৌকায় চড়তে! যখনি বাড়ি যায় তখনি নদীর দক্ষিণ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের বাজারটা দেখতে চেষ্টায় কোন ত্রুটি করিনা। কাউকে সঙ্গী পেলে প্রিয় গ্রামের মেঠু পথে হাটতে একটুও চিন্তা করিনা। আপনজনদের সাথে গ্রাম ঘুরে দেখার আনন্দ বলে বুঝানো সম্ভব নয়। সন্ধার পূর্বাপর চন্দ্র সূর্যের রশ্মি যখন নদীর পানিতে পড়ে তখন মনে হয় চন্দ্রসূর্য বুঝি নদীর আপন কেহ। কেন জানি তখন মনে হয় নদীর পানির সাথে চন্দ্রসূর্য একাকার হয়ে ভালোবাসার কথা বলছে। মাগরিবের পর চন্দ্রের কিরণে নদীর পানি যেন সাগরের মুক্তার মত ঝলমল করে। মনে হয় তখন গ্রামীন নদীর বুকে যেন হাজারো মুক্তার সমাহার। আমি অধম আমার গ্রামের এ সুন্দর ও মনোরম দৃশ্য দেখতে সবসময় সন্ধার পর নদীর পাশঘেসা মেঠু পথে ধীরগতিতে হাটি। আর নদীর মন মাতানো স্বপ্নিল ছবি দেখে খোদার দরবারে শুকরিয়া আদায় করি। সবচেয়ে ভাল লাগে যখন কাউকে এ মনোরম দৃশ্যের কথা বললে সে বলে সুবহানাল্লাহ, আমাদের গ্রামেও কুয়কাটার মত এতো সুন্দর দৃশ্য আছে! হায়, আমি তো এভাবে কোনদিন আমার গ্রাম ও নদী নিয়ে ভাবিনি। আমাদের এই বাজারটা ঘিরে যখন কাউকে স্বপ্ন দেখতে শুনি তখন অন্তরে খুশির ঢেউ ওঠে। যখন কানে আসে কেউ প্রিয় ফকিরের বাজার রায়পুর গ্রামটি নিয়ে নতুন কিছু ভাবছে তখন হৃদয়ে পরম সুখ ও শান্তি অনুভব হয়। মন চায় সেই স্বপ্নিল মানুষটির পাশে দাঁড়িয়ে আমিও ওখানকার সাদাসিধে মানুষগুলোর জন্য কিছু করি। স্বপ্নদ্রষ্টার হাতে হাত রেখে প্রিয় গ্রামটিকে নতুন করে সাঁজাই। গ্রামের খেটে খাওয়া সাদাসিধে মানুষের জন্য নিজেকে কুরবান করি। ওখানে পড়ুয়া ছাত্রদের প্রতিভা বিকাশে সহযোগিতার হাত বাড়াই। প্রতিভার সন্ধানে খুঁজি প্রতিভাবান ছাত্র। মানুষের মতো মানুষ হয়ে গ্রামের মুখ যে উজ্জল করতে চায় তার হাত টেনে ধরি। অধিকার বঞ্চিত মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দিই। সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত ভাতা গ্রামের আসল অসহায়দের কাছে পৌঁছে দিই। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রকৃত অভাবীদের চিহ্নিত করে তাদের দুঃখ- দুর্দশা মুছে দিতে সাহায্যের হাত প্রসারিত করি। গরীবের বন্ধুদেরকে সাথে নিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাত- ফেতরা ও দানের টাকা প্রকৃত হকদারদের বুঝিয়ে দিই। কিন্তু তা কি কোনদিন সম্ভব হবে অধমের দ্বারা? বাস্তবে কি রূপ নিবে দরধী মালীর বুকের আহাজারী? আছে কি এমন কেউ যে স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করবে? আমি জানিনা। জানা নেই এমন ব্যক্তি কখনো আসবে কিনা আমার জীবনে। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমার মত অনেকেই তাদের নিজ গ্রাম নিয়ে ভাবে। অনেকেই এমন আছেন যারা আপন জন্মভূমির উন্নতির সোপানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নিজ অঞ্চলের অসহায় মানুষদের কথা ভুলে গিয়ে কেউ কোনদিন বড় হতে পারেনা। তারা সফলতার সুঁউচ্চ মিনারে আরোহণ করতে পারেনা যারা নিজ গ্রামের দুঃখীদের ভুলে শহরে স্থায়ী হতে চায়। রক্তের বন্ধন ছিন্ন করে পরকে কাছে নিলে আপনের সুখ পাওয়া যায়না। শৈশবের প্রিয়দেরকে স্মৃতির পাতা থেকে মুছে অপরিচিতদের আপন করে নিলে বন্ধুত্বের স্বাদ অন্তরে অনুভব হয়না।
গ্রামের ইতিহাস একদম ভুলে গেলে প্রতিবেশীর ভালোবাসা শহরের জীন্দেগীতে পাওয়া মুশকিল। তাই আসুন, আমরা যারা গ্রামে কিংবা শহরে থাকি তারা সবাই সবার নিজ নিজ গ্রামের পরিবেশ আরো সুন্দর করতে উদ্যোগী হই। সবাই সবার গ্রামে বিভিন্ন গাছগাছালি লাগিয়ে মানুষকে বিশুদ্ধ পরিবেশে জীবনযাপন করার সুযোগ করে দেই। এবং গ্রামের অসহায় মানুষকে সহযোগীতা করে তাদের অভাব-অনটন দূর করতে সচেষ্ট হই। গ্রামের ভালোবাসা যেন কারো হৃদয় থেকে মুছে না যায় সে প্রত্যশা সবার কাছে। কারণ, ঢাকার কিং হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান- এর মত হয়তো আপনার সমাধীস্থল হতে পারে গ্রাম। কবি আল- মাহমূদ এর মত আপনারও তো হতে পারে শেষ ঠিকনা গ্রামের কোন বাগান! আজীবন শহরের বাসিন্দা হলেও মৃত্যুর পর আপনিও হয়তো ফকির আশরাফ-এর মত নিজ গ্রামের মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে পারেন! তো গ্রামকে অবহেলা নয়। বরং জন্মভূমিকে ভালবাসুন। গ্রামের লোকদের দেখে ঠাট্টা বিদ্রুপ না করে তাদেরকে ভালবেসে বুকে জড়িয়ে নেন। তবে রাসূলের মত আপনিও হবে প্রকৃত দেশ প্রেমিক। এবং আপনার সহযোগীতায় আপনার গ্রাম হবে এদেশের মডেল।