৬২ বছর পর ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়া ভাষা সৈনিক আজিম উদ্দিন চান রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি

বিশেষ প্রতিনিধি: “ঢাকার গগণে মেঘ ঘন বরষা, মিলিটারী ছাড়া আর নাহি ভরসা” রাশি রাশি ভাড়া ভাড়া ঘুষ খাওয়া হলো সারা,ক্রোধ ভড়া জনমত খড় পরষা। খাইতে খাইতে ঘুষ এলো বরষা। একখানি ছোট গদী, আমি একেলা, চারদিকে এমএলএ রা করিছে খেলা। সন্মুখে দেখি আাঁকা, জনতার দাবি মাখা, আঁধার কুয়াশা ঢাকা প্রভাত বেলা, বাঙলার মসনদে আমি একেলা। –ঢাকার গগনকুলে কালো মেঘ নেচে চলে শূন্য প্রাসাদ পুড়ে রহিনু পড়ি সবকিছু নিয়ে গেল আজব ভূঁড়ি। আমি তখন অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র। এই শ্রেনীতে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই আমার কাছ থেকে চিরতরে মুখ ফিরিয়ে নেন বিদ্যাদেবী । আমার অপরাধ স্বরচিত “আজব ভুঁড়ি” কবিতাটি পাঠ। সেই সময়ের লেখা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে নিজের স্মৃতিচারণ করছিলেন ভাষা সৈনিক আজিম উদ্দিন।
১৯৫২ সালে বাঙ্গলাকে মাতৃভাষা করার দাবিতে উত্তাল সারা পূর্ব পাকিস্তান। আন্দোলন যে কেবল ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ তা নয়। ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি পান্তরে। ১৯৪৮ সালে বাঙ্গলা ভাষার আন্দোলন শুরু হয় ঢাকাতে। পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষা দাবীর মিছিলে গুলি চালালে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। নেত্রকোণায় আমিও সে আন্দোলনে শরিক হই। সে বছর ডিসেম্বরে বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোণা মহকুমা আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনে আমার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করার জন্য আমাকে সরকার স্কুল থেকে চিরতরে বহিস্কার করে দেয়। তারপর আর আমার লেখা পড়া করা হয়নি।
নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার জারিয়া গ্রামে আমাদের (ভাষা সৈনিক আজিম উদ্দিন) বাড়ি। আমার পিতা মরহুম শেখ শমসের আলী ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। আমার পিতার মৃত্যুর পর নেত্রকোনা শহরের ইসলামপুরে মামার বাড়িতে লেখাপড়ার জন্য চলে আসি। ১৯৫০ সালে শহরের আঞ্জুমান স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হই। ১৯৫২ সালে আমি অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র ছিলাম। অষ্টম শ্রেনীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় আমি নেত্রকোণা মহকুমা ছাত্রলীগের সদস্য হই। তখন মহুকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত এমএলএ আব্দুল খালেক তালুকদার ও সাধারন সম্পাদক ছিলেন সাবেক এমপি প্রয়াত ফজলুর রহমান খান।
১৯৫২ সালে আমার স্বরচিত আজব ভূঁড়ি কবিতা পাঠের কয়েকদিন পরেই আমাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কবিতা লেখার কারণ জানতে চাওয়া হয়। জবাবে আমি লিখেছিলাম যা সত্য তাই লিখেছি। জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় পর পর ৩ বার আমাকে নোটিশ দেওয়া হয়। তারপরও আমার ছিল একই জবাব। অবশেষে ১৯৫৩ সালে স্কুল থেকে রাজটিকিট দেওয়া হয় আমাকে। ফলে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হওয়ার পরই আমি প্রগতিশীল সভা সমাবেশ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত সৃষ্টি, ভাষা আন্দোলনকে বেগমান করার জন্য বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠনে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখি। ছাত্রাবস্থায় স্কুলের মিটিং মিছিলের নেতৃত্ব, ভাষা আন্দোলনের পক্ষে আমার লেখা বিভিন্ন কবিতা তখনকার পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকে। ১৯৫১ ও ৫২ সালে আমার লেখা ‘পকেট ভারি’ ও ‘ঘুষের থলি’ নামক কবিতা দুটি স্কুল ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয়েছিল। যা তৎকালীন সরকারকে বিদ্রুপ করে লেখা। কিছুদিন পরেই তৎকালীন মুসলিমলীগ সরকার আমার কাছে কৈফিয়ত তলব করে। কেন সরকারকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে কবিতা লিখেছি এবং আবৃত্তি করেছি। আমার উত্তর সন্তোষজনক না হওয়ায় তাকে রাজটিকিট দেওয়া হয় বলে জানান আজিম উদ্দিন।
২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বর্তমান নেত্রকোণা আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রন করেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তৎকালীন নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক ড. তরুন কান্তি শিকদার ৮১ বছর বয়সের এই ভাষাসৈনিককে দীর্ঘ ৬২ বছর পর বিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেন। এতে তাঁর সারা জীবনে বয়ে যাওয়া সকল কলংক থেকে মুক্তির লাভ করেছেন বলে জানান তিনি।
ভাষা আন্দোলনের জন্য তিনি জীবনের সব কিছু হারালেও জীবনের ক্রান্তি লগ্নে তাঁর শেষ ইচ্ছে একুশে পদক। আজিম উদ্দিন জানান, আমি একুশে পদকের জন্য আবেদন করেছি। সরকারের কাছে আমার আবেদন আমি যেন মৃত্যুর আগে এ সন্মান নিয়ে মরে মরতে পারি।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।