অধ্যাপক মোস্তফা কামাল স্মারক বক্তৃতা: বাংলাদেশের সমসাময়িক অর্থনীতি ও রাজনীতি-এম এম আকাশ

অধ্যাপক মোস্তফা কামাল প্রসঙ্গে কিছু কথা: অধ্যাপক মোস্তফা কামাল সত্তুর পেরোনোর আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে আমার জ্যেষ্ঠ ছিলেন। জীবিত অবস্থায় তাঁর সংগে ঘনিষ্টভাবে মেলা মেশার সুযোগ আমার হয় নি। তবে দূর থেকে অনুভব করতাম তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। দেখা হলেই তাঁর সেই সুভাষিত হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটির কথা আমার এখন খুবই মনে পড়ছে। আমি নিশ্চিত যে তাঁর কমরেডরা, তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী ও নেত্রকোনাবাসী তাঁকে বিশেষভাবে মনে রাখবেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল ছেদহীন এবং উজ্জ্বল। তিনি আজীবন কমিউনিষ্ট ছিলেন। বিশ্বাস করতেন সাম্যবাদী সমাজে। সে জন্য যৌবনে এক সময়ে কমিউনিষ্ট পার্টির সার্বক্ষনিক কর্মীও হয়েছিলেন। পরে সে জন্য একটু বেশি বয়সেই (৩৯ বছর) তাঁর বিয়ে হয় কোহিনুর বেগমের সংগে। তাঁর সহধর্মিনী ও তাঁর সন্তনেরাও তাঁর আদর্শের অনুগামী হয়েছেন। কৃষক সমিতি, যুব ইউনিয়ন, ক্ষেতমজুর সমিতি, মহিলা পরিষদ, খেলাঘর, কোন গণসংগঠনই তাঁর কর্মঠ হাতের স্নেহস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়নি। শেষের দিকে তিনি সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দেলনেও আতœনিয়োগ করেছিলেন। নেত্রকোনায় দলমত নির্বিশেষে তিনি সর্বজনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। এ ধরনের লোকনেতা ছাড়া সমাজে সাম্যবাদী আদর্শ ও সংস্কৃতির স্বতঃস্ফুর্ত আধিপত্য (Hegemony) প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আজ তাই এই ধরনের প্রাতঃস্মরণীয় একজন কমরেডের স্মরণ অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা প্রদানের সুযোগ পেয়ে আমি নিজে অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি এবং বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ জানাই আমাদের আরেকজন স্বনামধন্য লোকনেতা যতীন সরকার ও অন্যান্য আয়োজকবৃন্দকে। কারণ তাঁরাই আজ আমাকে সে সুযোগটি করে দিয়েছেন। আজকের স্মারক বক্তৃতার জন্য আমি যে শিরোনামটি বেছে নিয়েছি তা হচ্ছে, ‘‘বাংলাদেশের সমসাময়িক অর্থনীতি ও রাজনীতি”। আশা করি এটি আপনাদের পছন্দ হবে।

প্রকৃত উন্নয়নের সংজ্ঞা
উন্নয়ন নিছক প্রবৃদ্ধি নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। তার কেন্দ্রে অবস্থিত হচ্ছে মানুষ। যখন সমাজের অধিকাংশ সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক উন্নয়ন হয় এবং সামগ্রিকভাবে সর্বজনের (Public) স্বাধীনতা ও সক্ষমতা ভারসাম্যপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে, তখন তাকে আমরা ‘আদর্শ উন্নয়ন’ বলতে পারি। একসময় নিজের ‘‘অপ্রিয় প্রতিষ্ঠান”((ÒNot FavouriteÓ) খোদ বিশ্বব্যাংকে বক্তৃতা দিতে গিয়ে স্বয়ং অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, ‘‘মানুষের বাস্তব পরাধীনতাগুলির অপসারণই হচ্ছে উন্নয়ন”। এটিকে উন্নয়নের নিছক পরিমাণগত কোন সংজ্ঞায় বা নির্দেশকে পরিণত করা বিশ্বব্যাংকের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। এর অত্যন্ত কাছাকাছি একটি সংজ্ঞা হতে পারে, ‘সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে উন্নয়ন’। তবে এখানে সাম্যবাদী সমাজের যে সংজ্ঞাটি আমাদের ব্যবহার করতে হবে তা হচ্ছে ইশতেহারের অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত মার্কসের একটি সংজ্ঞা, মার্কস লিখেছিলেন, ‘‘শ্রেনী ও শ্রেণী বিরোধ সংবলিত পুরানো বুর্জোয়া সমাজের স্থান নিবে এক সমিতি (নি¤œরেখ লেখকের।) যার মধ্যে প্রত্যেকটি লোকেরই স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত।” (কমিউনিস্ট ইশতেহারের শেষ বাক্য দ্রঃ) । আমি ধারণা করি সেরকম একটি সমাজব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়া তথা সেরকম একটি উন্নয়নের স্বপ্নই হৃদয়ে ধারণ করতেন কমরেড মোস্তফা কামাল।
কিন্তু বিশ্বে সাধারণত এ রকম আদর্শ সর্বাংগসুন্দর উন্নয়ন এখন পর্যন্ত হয়নি। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজে এবং চীনে আমরা এক সময় দেখেছি বহু আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও এবং আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা সকলের জন্য না থাকলেও বা প্রচলিত অর্থে ‘‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র” না থাকলেও অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সর্বজনের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছিল। আবার সেসব দেশে বিশেষতঃ রাশিয়ায় একটা পর্বে এসে বাজারকে এবং ব্যক্তিগত প্রণোদোনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হলো। তার ফলে ভেতরেই দেখা দিল কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতি- এমন কি কারো কারো মতে সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত¦ খাতের প্রশাসকরা অন্য নামে নতুন এক ‘‘অধিপতি শ্রেণীতে” পরিণত হয়েছিলেন। সময়োচিত সংস্কারের ঘাটতির কারণে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থবির হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা বলতে পারি, সাম্যবাদের প্রাথমিক পর্বে প্রত্যেকের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র ছাড়াও সুষম অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এগিয়ে যেতে পারে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা টেঁকসই থাকতে পারেনি। বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতি-পশ্চাদ্গতির ইতিহাস থেকে এই সত্যসমূহ আজ আমাদের হৃদয়ংগম করতে হবে।

বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা
বর্তমানে এ দেশে মিশ্র অর্থনীতি বিদ্যমান। রাষ্ট্রীয় খাত, সমবায় খাত ও ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের ক্রমবর্ধমান দক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ উদ্যোগ এবং সেখানে নাগরিকদের সামাজিক ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সুযোগ ও সেজন্য মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কের সংস্কার ছাড়া উন্নয়ন এদেশে দক্ষ, সুষম ও টেঁকসই হবে না। বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্বে ধীরলয়ে (৪ থেকে ৫ শতাংশ হারে) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০০০ সালের পর তা বাড়তে বাড়তে প্রথমে ৫, পরে ৬ এবং অবশেষে ৭ শতাংশে উপনীত হয়েছে। সামাজিক নির্ণায়কের ক্ষেত্রে যেমন নারীর অগ্রগতি, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি এই ধরনের মানব উন্নয়ন, কৃষি উন্নয়ন, রেমিট্যান্স ও পোশাকশিল্পে লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। এসব কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে এখানে দুটো স্থায়ী ঘাটতি থাকছেÑ ১. এই উন্নয়নের ফল সব মানুষ সুষমভাবে পাচ্ছে না। ২. ধনী-গরিবের আয়-সম্পদ-শিক্ষা-চিকিৎসা বৈষম্য দৃষ্টিকটুভাবে বাড়ছে। তা ছাড়া দারিদ্র্যের আপেক্ষিক হার হ্রাস পেলেও মোট দরিদ্র লোকের সংখ্যা এখনো প্রায় ৩-৪ কোটির সমান। এই সংখ্যা বিশ্বের অনেক ছোট দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশী। শুধু তাই নয়, ৪০ বছর ধরে সব সরকারের আমলেই দেখছি ধনী ও গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বেড়েছে এবং বাজারের ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। রাষ্ট্র তাদেরই সেবা করছে। তাই ভবিষ্যতে সুশাসন ও গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা টেকসই নাও হতে পারে।
বর্তমান উন্নয়ন ধারায় গরিবের একদম কিছু হচ্ছে না তা আমি বলছি না। গরিবও এগোচ্ছে, ধনীও এগোচ্ছে। কিন্তু ধনী এগোচ্ছে খরগোশের গতিতে আর গরিব এগোচ্ছে শামুকের গতিতে। বাংলাদেশে অতি ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি (১৭.৪%)। গড় আয়ও অনেক বেড়েছে! যদি বলি আমার অর্ধেক শরীর ফ্রিজে, অর্ধেক শরীর চুল্লির মধ্যে আছে আর সব মিলিয়ে আমি গড়ে নাতিশীতোষ্ণ আছি ব্যাপারটা অনেকটাই সে রকম। সেজন্য মানুষ এসব উন্নতির পরও সমতা ও সুশাসনের অভাবে অসন্তুষ্ট।
মানুষ বাস্তবে দেখছে যে, সে পরিশ্রম অনুযায়ী ফল পাচ্ছে না। কিন্তু আরেকজন পরিশ্রমের তুলনায় অনেক বেশি পাচ্ছে। আসলে উন্নয়ন হচ্ছে সবারই। তবে নিচের দিকে উন্নয়ন হচ্ছে তুলনামূলক অনেক কমমাত্রায়। ওপরের দিকে বেশিমাত্রায় হচ্ছে। তার ফলে আয় বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। সব জায়গাতেই বৈষম্য লক্ষণীয়। আমরা যে গড় আয়ু বৃদ্ধির কথা বলছি সেখানেও গরিবের গড় আয়ু অতটা বাড়েনি। শিক্ষার হারের কথা যদি বলি, গরিবের ঘরে শিক্ষার মান যতটা বেড়েছে ধনী ও মধ্যবিত্তের ঘরে তা বেড়েছে অনেক বেশি। আগে অনেকেই প্রাইমারি স্কুলে পড়তে পারত না। এখন পারছে। কিন্তু গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মান আর শহরের প্রাইমারি স্কুলের মানে অনেক তফাৎ। শহরের সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মান আর বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলের মানেও অনেক বৈষম্য। স্বাস্থ্য খাতেও বৈষম্য আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যটা হয়তো পরিমাণগতভাবে দেখা যাবে না। কিন্তু গুণগতভাবে দেখতে পাব। যেমন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে হয়তো অনেকেই বলবেন, কমিউনিটি ক্লিনিক অনেক হয়েছে। সবাই স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। কিন্তু অল্পসংখ্যক ধনী স্কয়ার হাসপাতাল বা সিঙ্গাপুরে গিয়ে যে মানের সেবা পাচ্ছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বারান্দায় যে রোগীটি আছে সে তো তা পাচ্ছে না। তার মানে প্রতিটি স্তরে আমরা একটা বৈষম্য সৃষ্টি করে ফেলেছি। সমাজটা আর ঐক্যবদ্ধ থাকছে না। সমাজে হিংসা বা ঈর্ষার প্রতিযোগিতা চলছে। তাই উন্নয়ন বলা যাবে গড়ে অথবা ধনী সংখ্যালঘুর দৃষ্টিতে কিন্তু বণ্টনের দিক থেকে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার দিক থেকে এটাকে আদর্শ উন্নয়ন বলা যাবে না।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বর্তমানে তার শিল্পের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। আর শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য পুঁজি বিনিয়োগ ও শ্রমিকের দক্ষতা বাড়াতে হবে। আর নতুন প্রযুক্তি আনতে হবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। এভাবে চললে ১০ বছর পরের বাংলাদেশ আরেকটু উন্নত হবে হয়তো মধ্যম আয়ের কাছাকাছি চলে যাবে। এবং গণতন্ত্রের ইস্যুটা আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ হবে। কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন যখন অগ্রসর হয়ে যায় তখন রাজনৈতিক উন্নয়নটা বেশিদিন পিছিয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু এই ১০ বছরে যদি রাজনৈতিক কোনো বড় অস্থিতিশীলতা হয়, গণতন্ত্রের সঙ্গে কর্তৃত্বপরায়ণতার দ্বন্দ্বটা যদি শান্তিপূর্ণভাবে সংস্কারের মাধ্যমে সমাধান না হয় এবং উল্টো নৈরাজ্য ও বিস্ফোরণ ঘটে তবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ যদি পিসফুল রিফরমেশন না হয়, যদি সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া না হয় অর্থাৎ সেলফ রিভিশন ও রিমিশন না হয় তা হলে বাংলাদেশ হয়তো মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হবে। কোনটা যে হবে তা এই মুহূর্তে বলা মুস্কিল। অধিকসংখ্যক মানুষ যদি দেখে তারা যে রকম কাজ বা কষ্ট করছে কিন্তু সে রকম কিছু পাচ্ছে না, আর অল্পসংখ্যক মানুষ যদি দেখে কোনো কাজ ছাড়াই অনেক কিছু পাওয়া যাচ্ছে, যেমন চাইলেই ব্যাংক থেকে টাকা পাচ্ছে, তা আবার দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশেও পাঠিয়ে দিতে পারছে। কর ফাঁকি দিতে পারছে, ঋণ শোধ না করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। সেই সমাজটা তো মসৃণভাবে চলার কথা নয়।

বিদ্যমান রাজনীতি ও ক্রমসংকোচনশীল গণতন্ত্র
অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র থাকলে অধিকাংশ মানুষ ভোট দিয়ে এমন সরকার আনত, যে সরকার লুটেরাদের প্রশ্রয় না দিয়ে জনগণের সেবাকে অধিকতর গুরুত্ব দিত। কিন্তু আমাদের দেশে যে ভোটের গণতন্ত্র ১৯৯০ সালের পরে জন্ম নিয়েছে, তার অনেক নেতিবাচক দিক রয়েছে। এর আগে ১৯৭১-৭৫ কালপর্বেও ন্যূনতম উদারনৈতিক এক ধরনের গণতন্ত্র ছিল। ১৯৭৫ সালে তাকে ”শোষিতের গনতন্ত্রে” পরিণত করার উদ্যোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে নিহত হন। আবার ১৯৭৫-৯০ কালপর্বে ছিল লেবাসি গণতন্ত্র। ৯০ এর পর কিছুদিন চালু ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বিদলীয় গণতন্ত্র। সব শেষে চালু হয়েছে অনুদার বা কর্তৃত্বমুলক (Illiberal and Authoritarian) গণতন্ত্র। সব মিলিয়ে আমাদের ভোটের গণতন্ত্র ফলপ্রসু বা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
এধরনের সংকুচিত ভোটের গণতন্ত্র এমনকি আদর্শ বুর্জোয়া গণতন্ত্র নয়। কোন কোন উন্নত পুঁজিবাদী দেশে বিদ্যমান এধরনের সীমিত ভোটের গণতন্ত্রকে Illiberal Democracy বা Authoritarian Rule বলে। অর্থাৎ এমন তথাকথিত ‘গনতন্ত্র’ আছে যাকে ‘অনুদার গণতন্ত্র’ বা ‘কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন’ বলা হয়। এখানে যে কর্তা গণতন্ত্রের চর্চা করছেন বা যে দল গণতন্ত্রের চর্চা করছে, সেই দল বা তিনি নিজে তার দলের ভেতর থেকেই কর্তৃত্বপরায়ণ একজন কর্তা হিসেবে নানা কারণে উঠে আসেন। তার কর্তৃত্বের অধীনে অনেকেই আছেন। বাংলাদেশে সম্প্রতি এধরনের গনতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হয়ে গেছে এই কারণে যে, এখানে প্রধান বিরোধী দল বা সরকারি দল উভয়ই এ দেশে কর্তৃত্বপরায়ণ দুটি দল। উভয়েই দেশে অনুদার গণতন্ত্র চালাতে ইচ্ছুক। তাই মানুষের কাছে ‘চয়েস’ হচ্ছে এই কর্তৃত্ব বা ওই কর্তৃত্ব। তাই এখানে অনুদার গণতন্ত্র স্থায়ী হয়ে গেছে। একজনের কর্তৃত্বপরায়ণ রাজত্ব যদি মানুষ অস্বীকার করে তবে আরেকজনের কর্তৃত্বপরায়ণ রাজত্ব আসে। কে এমপি পদে মনোনীত হবে, কাকে উচ্চ পদ দেওয়া হবে সব নির্ধারিত হচ্ছে অগণতান্ত্রিকভাবে, কখনো কখনো টাকা-পয়সা, স্বজনপ্রীতি ও সচরাচর শীর্ষ কর্তৃত্ব দ্বারা। তবে এই দুই দলে কর্তৃত্বে যে দুজন আছেন তাদের মধ্যে কে বেশি উদার এসব বিচার করে কখনো কখনো মানুষ একটি দলে আসে, আবার অসহ্য হয়ে গেলে আরেকটি দলে যায়। এভাবেই এতদিন চলে আসছে। ফলে ১৯৯০ সালের পর থেকে কর্তৃত্বপরায়ণ অনুদার গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্র ও সমাজ কখনোই রক্ষা পায়নি। তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটির কৃতিত্ব হচ্ছে যে ইতোমধ্যে তারা তাদের ক্ষমতা যথেষ্ট সংহত করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন এবং বিরোধী দলের তথাকথিত কর্তৃত্বের দুই আইকন মাতা-পুত্রের ভাবমূর্তিও ধ্বংস করে দিয়েছেন। এর ফলে দ্রুত নতুন ইতিবাচক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব না হলে বিদ্যমান কর্তৃত্ববাদের প্রবনতা আরো শক্তিশালী হবে।
কর্তৃত্বমুলক গণতন্ত্রের ট্র্যাজেডির মধ্যে থেকেই সম্প্রতি বাংলাদেশের যতটা উন্নতি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি উন্নয়ন কিন্তু সম্ভব ছিল। এমনকি এ অবস্থায় বৈষম্যহীন উন্নয়নও সম্ভব হতে পারে যদি কঠোর রাষ্ট্রের (Hard State) কর্তৃত্ব কিছুটা আলোকিত উদ্দেশ্য অভিমুখী হয়। আমাদের সামনে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের উদাহরণ আছে। এক দলীয় রাজনৈতিক কঠোর কর্তৃত্ব যদি সুষম বণ্টনের দিকটা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পরিবর্তনে আগ্রহী হয়, যদি অন্ধ দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তার কর্তৃত্ব কিছুটা বিকেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক পথে খাটিয়ে সাধারণ মানুষকে অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধির মধ্যে নিয়ে আসতে ইচ্ছুক হয় এবং সর্বোচ্চ কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকটি নিজে যদি অসৎ ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সক্ষম হয়, তা হলে কর্তৃত্বপরায়ণতা যে জনপ্রিয় ও ফলপ্রসু হয়ে উঠতে পারে তা এসব দেশের উদাহরণ দ্বারা প্রমানিত হয়েছে।
চীনের শি-পিং বা সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান বা মালয়েশিয়ার মাহাথিরের সাম্প্রতিক দৃষ্টান্তটি অনেকে দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে যে কর্তৃত্বপরায়ণ গণতন্ত্রের ধারা বিরাজমান তা সুশাসন ও সমতাকে একেবারে বাদ দিয়ে নিছক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কিছু পরিমাণে চরম দারিদ্র্য কমানোর দ্বারা ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন, সেটা মুশকিল। সেটা হয়তো মন্দের ভাল হিসাবে কিছুদিন পারবেন যদি দেখাতে পারেন যে, নিজস্ব কর্তৃত্বের চেয়ে অপর বিকল্পটি মোটেও উন্নততর নয় বরং আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু সেটাও কিছুদিনের জন্য টিঁকবে, দীর্ঘদিন নয়।

উন্নত এন্টি বডির সন্ধানে
অধিকাংশ প-িতেরাই এখন মানেন যে, দীর্ঘমেয়াদে কর্তৃত্বপরায়ণতা বা অনুদার গণতন্ত্র সচেতন স্বচ্ছল নাগরিকেরা মানবে না। কারণ যে কোনো জায়গায় যখন সাধারণ জীবনমানের উন্নয়ন একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে চলে যাবে, তখন মানুষের সামনে গণতান্ত্রিক অধিকার ও Civil Rights এর প্রশ্নগুলো আসবে। বৈষম্য কেন হচ্ছে? লুটপাট কেন হচ্ছে? স্বজনপ্রীতি কেন হচ্ছে? সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আমার কন্ঠস্বরের ভূমিকা কই? এই প্রশ্নগুলো উঠবে। এখন হয়তো এত চিন্তা করছে না বা ভাবছে এসব তো হবেই, আমার জীবনমান তো বাড়ছে। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠলে তারা বলবে, আমি কেন আপেক্ষিক ভাবেও বঞ্চিত হব? তাছাড়া বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মনস্তত্ত্বে ভোট ও গণতন্ত্র প্রীতির মাত্রা বিভিন্ন হতে পারে। শাসক কর্তৃক ম্যানেজেবল জনসংখ্যাও একেক দেশে একেকরকম হতে পারে। তাই ভিন্ন আন্তর্জাতিক পটভূমিতে চীনে বা দক্ষিণ কোরিয়ায় যা তখন সম্ভব হয়েছিল বর্তমানে বাংলাদেশে তা সম্ভব নাও হতে পারে।
কোথাও কোথাও অনুদার গণতন্ত্র Developmental State-এ পরিণত না হয়ে নিছক স্বৈরতন্ত্রেও পরিণত হতে পারে। মার্কোসের ফিলিপাইন সেরকম একটি উদাহরণ। আমাদের দেশে অতীতে জেনারেল এরশাদের আমলটিও সেরকম একটি উদাহরণ যদিও এখন তা অনেকে ভুলে গেছেন। আমার শিক্ষক আনিসুর রহমানের উদাহরণটা আমি দিতে পারি। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন একটা মানুষকে গলা কামড়ে ধরেছে একটা নেকড়ে বাঘ, আর আরেকটা বাঘ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে জিভ চাটছে, মানুষটা তখন কী করবে? সে নিশ্চয়ই নেকড়ে বাঘটাকে সরাতে চেষ্টা করবে কিন্তু সে জানে নেকড়েটাকে সরালে বাঘটা তাকে এসে ধরবে। তাই বাঘটার বিরুদ্ধেও তাকে একই সঙ্গে লড়তে হবে। এটা খুবই কঠিন অবস্থা কিন্তু এটাই সত্য বলে বাংলাদেশের অনেকেরই ধারণা। নির্বাচনের মাধ্যমে এ অবস্থার পরিবর্তন করা খুবই দুরূহ। নির্বাচনে রয়েছে তিন ‘গ’ এর আধিপত্য। Money, Muscle and Manupulation. বলা হয়ে থাকে নির্বাচনে কালো টাকার ব্যাপক ব্যবহার হয়, যে কালো টাকা দিয়ে একশ্রেণির ভোটারকে পর্যন্ত কিনে ফেলা যায়। আগামী সব নির্বাচনেই এমন আশঙ্কা থাকছে। কিন্তু এওও বাহ্য।
মূলত কর্তৃত্বপরায়ণ দলগুলো এদেশে তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য সমাজে অসংখ্য এজেন্ট তৈরি করেছে। বিষয়টা এমন যে, তুমি কালো টাকা করবে বা করেছ আমি জানি, তুমি টাকা বিদেশে পাচার করবে বা করেছ তা-ও আমি জানি। কিন্তু আমার নির্বাচনী খরচটা যদি দাও, আমার কর্তৃত্ব যদি বহাল রাখতে সাহায্য করো তা হলে তোমাকে কিছু বলব না এবং ক্ষমতায় এলে তোমাকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। সুতরাং কালো টাকা একটা সিস্টেমের অংশ এবং ক্ষমতারও অংশ হয়ে গেছে। ফলে একটা এলাকায় এমপি ইলেকশনে বর্তমানে নাকি ১০০ কোটি টাকাও ব্যয় হয়! আইনে তো আছে, ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে তারা অংশগ্রহণ করছে। অর্থাৎ আইনটা আছে, যা প্রণয়ন করেছে শাসক দল। কিন্তু আইনটা যেন বাস্তবায়িত না হয় সেজন্য জুডিশিয়ারির মাধ্যমে একটা দু’নম্বরী পদ্ধতিও তৈরি করে রেখেছে। জুডিশিয়ারী ব্যর্থ হলে প্রশাসনকে কাজে লাগাচ্ছে। তার মানে আমি মানুষকে দেখাচ্ছি যে, আমি কর্তা এবং আমার আইনগুলি সৎ কিন্তু আমার সাঙ্গপাঙ্গরা অসৎ অতএব আমি কি করতে পারি? কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে ভেতরে ভেতরে আসলে আমি অসৎ কারণ আমি আমার আশেপাশে অন্যায় সহ্য করছি, আইন ভঙ্গকে প্রশ্রয় দিচ্ছি।
কিন্ত এরপরেও আমরা জানি যে বিদ্যমান সিষ্টেমটি আভ্যন্তরীণ নানা দ্বন্দ্বে দীর্ণ । রয়েছে ক্ষমতাসীন লুটেরাদের নিজস্ব ভাগাভাগির দ্বন্দ্ব। রয়েছে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। রয়েছে বুর্জোয়াদের বিভিন্ন অংশের দ্বন্দ্ব যদিও আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এখন এটা অনেকখানি স্তিমিত। সমগ্র সামাজিক পরিম-ল জুড়ে এছাড়াও রয়েছে পশ্চাৎপদ ধ্যান ধারণার সঙ্গে আধুনিক ধ্যান ধারণার দ্বন্দ¦। রয়েছে জনগণের সঙ্গে মাঠে ময়দানে তৃনমূলে দুর্নীতিবাজ গনশত্রুদের দ্বন্দ্ব। রয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তির দড়ি টানাটানির দ্বন্দ্ব। রয়েছে মৌলবাদী জঙ্গী শক্তি, লুটেরা বুর্জোয়া শক্তি, লিবারেল বুর্জোয়া শক্তি, বাম-প্রগতিশীল শক্তি, ধর্মীয় নানাধরনের সুবিধাবাদী সামাজিক শক্তি এবং নানা পেটি বুর্জোয়া সুবিধাবাদী শক্তির প্রতিনিয়ত ক্ষমতাকে ঘিড়ে নিরন্তর এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা। এই দ্বন্দ্বগুলি সব যদি কখোনো একটি বিন্দুতে আকস্মিকভাবে ঘনীভূত হয় তাহলে সেই দুর্বল গ্রন্থিতে তখন সৃষ্টি হতে পারে চরম পরিবর্তনের কোন সুযোগ। তীব্র কোন অর্থনৈতিক শক্ থেকেও এরকম ঘনীভূত সংকটের উদ্ভব হতে পারে। কিন্ত সেরকম সুযোগও কুশলী রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে জনগণের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। আবার হিসাবের ভুল হলে ‘এডভেনচারে’ পা হড়কে বাম-গনতান্ত্রিক বিকল্পের অপমৃত্যুও হতে পারে বা সে অন্য কোন শক্তির দ্বারা ব্যবহৃতও হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাম প্রগতিশীলদের বা জনগণের ঘাড়ে পা রেখে উপরে উঠে আসতে পারে শাসক শ্রেণীর ভেতর থেকেই কোন লৌহ মানবের ষ্ট্রং ষ্টেট, কোন ধর্মীয় ছদ্মবেশী একনায়ক বা নতুন কোন সদ্য গঠিত গণতান্ত্রিক উদারনৈতিক বুর্জোয়া দলের প্রতিনিধি। এদের ফলাফলে তারতম্য থাকলেও আখেরে এর কোনটির ফলাফলই জনগণের জন্য মৌলিকভাবে শুভ হবে না।
কখনো কখোনো সিষ্টেমের মধ্যে বা বাইরে বৃহত্তর সমাজে কোনো একক ব্যক্তি একটা ব্যতিক্রমী ইতিবাচক রোল প্লে করে থাকেন। ধরা যাক দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান ব্যক্তিটি যদি ঝুঁকি নেন। যেমন তিনি যদি স্থির করেন, ‘আমি আমার পরিবেষ্টনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও ন্যায় এবং সত্যের পক্ষে লড়াই করব। ওই যে ম্যাজিস্ট্রেট রোকনুজ্জামান খান ঝুঁকি নিয়ে সব ভেজাল ধরল। ওইরকম কোনো শক্তিশালী একরোখা লোক কোথাও থাকলে ভূমিকা রাখতে পারে। তখন কোন কোন খাতে রাষ্ট্রের ভেতরে বা রাষ্ট্রের বাইরে আংশিক ও স্থানীয় পরিবর্তনের একটি ধারাও সৃষ্টি হতে পারে। বডির মধ্যে এসব এন্টি বডির সঙ্গে বাইরের আম জনগণের আন্দোলনকে যুক্ত করার মাধ্যমে হয়তো কোন একদিন মৌলিক পরিবতর্নের জন্য সচেতন একটি পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণও সম্ভব হতে পারে। তবে তার জন্য সারা দেশ জুড়ে মোস্তফা কামালের মত নিবেদিতপ্রাণ অসংখ্য কা-ারীর পূর্বউপস্থিতি প্রয়োজন হবে। আমরা সাম্যবাদীরা এখন সেটা তৈরীর কাজে নিয়োজিত আছি। এতক্ষণ আমার বক্তব্য ধৈর্য ধরে শোনার জন্য আপনাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।