বাংলা আমার মায়ের ভাষা ও ৫২’র ভাষা আন্দোলন -কমরেড আনোয়ার হোসেন ফকির

কমরেড আনোয়ার হোসেন ফকির: মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি এ তিনটি শব্দ প্রত্যেক মানুষের অতি আপন। মাকে রক্ষণাবেক্ষণ করা যেমন প্রত্যেক সন্তানের দায়িত্ব কতর্ব্য, ঠিক তেমনি মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে রক্ষা করা প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব ও কতর্ব্য। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার আগেই বির্তক শুরু হয়। এ রাষ্ট্রের ভাষা কি হবে? ১৯৩৭সালে জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা উর্দু করার প্রস্তাব করলে, বাঙ্গালীদের নেতা শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক এর বিরোধীতা করেন। ১৯৪৭সালে বিতর্কটি পুনরায় শুরু হয়। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহম্মদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ভাষা বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ বেশ ক’জন বুদ্ধিজীবি প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ জানান। ১৯৪৭সালে কামরুদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান’এর দাবি জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সচিবালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মিছিল, সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান সরকার ১৪৪ধারা জারিসহ সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৮সালে ২৩ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান গণপরিষদে বাঙ্গালী সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার ব্যবহারের দাবি জানান। তাঁর দাবি অগ্রাহ্য হলে ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পূণর্ঘটিত হয়। ১১মার্চ বাংলা ভাষা দাবি দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ঐদিন সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন হলে সমবর্তনেও তিনি অনুরুপ ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে এবং না’, না’ বলে তাঁরা উক্তির তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫২ সালে ২৬শে জানুয়ারী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন জিন্নাহকে অনুকরণ করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘোষনা প্রদান করে। এর প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ ৩০ জানুয়ারী ধর্মঘট পালন করে। আব্দুল মতিনকে আহবায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। দেশ ব্যাপী জনমত গড়ে উঠতে থাকে। ২০ ফেব্রুয়ারী সরকারি এক ঘোষনায় একুশে ফেব্রুয়ারী থেকে ১৪৪ধারা জারিসহ সভা সমাবেশ, মিছিল এক মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। আন্দোলনের নেত্রীবৃন্দ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা না করা নিয়ে অনেক আলোচনা শেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২১ফেব্রুয়ারী সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় একটি সভা অনুষ্টিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ১০জন করে মিছিল শুরু করা হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিক থেকে ১৪৪ধারা ভঙ্গ করে মিছিল এগিয়ে চলে। পুলিশ প্রথমে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। মিছিলে লাটি চার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে আবুল বরকত, জব্বার, রফিক, সালাম ও নয় বছরের শিশু ওহিউল্লাহসহ আরো অনেকেই শহীদ হন, অনেক আহত হন। ঢাকায় ছাত্র হত্যার খবর দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২২শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় বিশাল শোক র‌্যালি বের হয়। এখানে পুলিশের হামলায় শফিউর নামে একজনের মৃত্যু হয়। শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য ঢাকায় ২২শে ফেব্রুয়ারী ছাত্র জনতা মেডিকেল কলেজের সামনে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে। ২৩শে ফেব্রুয়ারী শফিউরের পিতাকে দিয়ে শহীদ মিনার উদ্ভোধন করা হয়। ১৯৪৭ সালে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালে প্রতিবাদ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের রুপ লাভ করে। ফলে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। আওয়ামীলীগ সরকারের উদ্যোগে ১৯৯৯সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো বাংলাদেশের ২১ ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত প্রদান করে। পৃথিবীতে ৬’ হাজারেরও বেশি ভাষাভাষীর মানুষ আছে, তারা সকলেই যেন নিজের মাতৃভাষাকে রক্ষা ও শ্রদ্ধা করে।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।