কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামালের প্রথম মৃত্যুবাষির্কী আজ

আবুল কাইয়ুম আহম্মদ : মনুষ্যত্ব হলো মানুষের চিরাচিরত বা শ্বাশত স্বভাব বা গুণ। যে গুণের মধ্যে দিয়ে নন্দিত মানুষের প্রকৃত স্বরূপ ফোটে ওঠে। এগুলোর সব গুনাগুণ কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামালের মধ্যে বিদ্যমান ছিল বলেই তিনি একজন মহান মানুষ রূপে পরিণত হয়েছিলেন। নেত্রকোণা সমাজতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রসৈনিক কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামাল সকলের কাছে কামাল স্যার নামে পরিচিত। তাঁর জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট খামারাটি গ্রামে। শৈশবে তাঁকে সবাই ওয়াজিব উদ্দিন নামে ডাকতো। পিতা হাছেন উদ্দিন সরকার, মাতা জহরেন্নেচ্ছা। হাছেন উদ্দিন সরকার পূর্বধলা ১২নং বৈরাটি ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট (বর্তমান চেয়ারম্যান) ছিলেন। বিপুল বিত্তের অধিকারী হয়েও পরিবারটি কারো ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন করেননি। দানশীল হিসাবে তাদের পরিবারের সুনাম ছিল প্রবাদ প্রতিম। এর প্রভাব কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামালের ভবিষ্যৎ জীবনের গতিধারা নির্ধারণে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল। বাল্যকাল থেকে কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামালের সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। একদিন থানার বড় দারোগা তাদের বাড়িতে আসলে, তিনি একটি বাঁশের কঞ্চি নিয়ে পথরোধ করে দাঁড়ালেন। বড় দারোগা কমরেড মোস্তফা কামালের এ সাহস দেখে অবাক হন এবং তিনি বলেন- ‘ছেলেটা বড় হয়ে কিছু একটা হবে’। ছোটবেলায় মোস্তফা কামাল ভলিবল খেলা নিয়ে মেতে থাকলেও ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। একবার যা পড়তেন তা খুব অল্পেই আয়ত্ত করতে পারতেন। কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামালের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বাইন্জা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ২য় শ্রেণিতে অধ্যয়ণরত অবস্থায় তিনি পিতৃহারা হন। তখন তাঁর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়। অতঃপর বড় ভাই অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন আহমদের সান্নিধ্যে এসে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি গৌরিপুর আর.কে হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যয়নরত অবস্থায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক যতীন সরকারের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯৬৫ সালে উক্ত স্কুল থেকে এস.এস.সি পাস করেন। তারপর তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা সরকারি কলেজ থেকে তিনি এইচ.এস.সি পাস করেন। নেত্রকোণা সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বি.এ এবং ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন। বর্তমান সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামাল এর সহপাঠি ছিলেন। তাছাড়া কমরেড মণি সিংহ, কমরেড খোকা রায়, কমরেড অজয় রায় প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি জহুরুল হক হল শাখার ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানে ও ১৯৭০ এর আন্দোলন এবং সাধারণ নির্বাচনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বিশাল জনসভায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা হিসাবে কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামাল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে তিনি ঢাকা থেকে নেত্রকোণা পূর্বধলা কামারাটি গ্রামে চলে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আশপাশের যুবকদের সংগঠিত করেন। আনুমানিক এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি নেত্রকোনা-দুর্গাপুর হয়ে বাঘমারার ঢালু-বারেঙ্গা (সিপিআই) ক্যাম্পে যোগদান করেন। তারপর তেজপুর থেকে ট্রেনিং নিয়ে ন্যাপ, কমিউনিস্ট, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দেশ স্বাধীনের পর নেত্রকোনায় ফিরে আসেন এবং কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামাল ১৯৭৩ সালে মার্কস-লেলিনের ওপর প্রশিক্ষণের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে যান। নির্দিষ্ট সময় শেষে মার্কসবাদের তিনটি অংশ মার্কসীয় দর্শন, অর্থনীতি এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বিষয়ে ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট অর্জন করেন। প্রশিক্ষণে তাঁর অসামান্য মেধার পরিচয় পেয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রশিক্ষণার্থী ও প্রশিক্ষকগণ তাঁকে ভূয়সী প্রশংসায় ভূষিত করেন। কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামাল ১৯৭৪ সালে নেত্রকোণায় এসে সিপিবির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। বিরামহীন ছিল তাঁর সেই কাজের ধারা। কিছুদিন পর তিনি শহর কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি নেত্রকোণায় সুকুমার ভাওয়াল, মৃনাল বিশ্বাস, আব্দুল মোত্তালেব সুরুজ মিয়া, কুন্তল বিশ্বাস তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পার্টির কার্যক্রম চালাতেন। ’৮০ এর দশকে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন নেত্রকোণা জেলা কমিটির সভাপতি পদে পর পর দু’বার নির্বাচিত হন। নেত্রকোণায় ’৮০ এর দশকে ক্ষেতমজুর সমিতির আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আন্দোলনের লড়াই সংগ্রামে কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামালের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। ১৯৯০ সালে জেলা সম্মেলনে তিনি নেত্রকোণা জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সাল নেত্রকোণা মহিলা কলেজ সরকারিকরণ করা হলে তিনি সম্পাদক পদ থেকে নিজেই অব্যাহতি দেন। ১৯৯৫ সালে তিনি পুনরায় কে পাশা নামে জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে পার্টি ভাঙার পর নেত্রকোণার পার্টিকে তিনি শক্তিশালী করে তোলেন। ’৯০ এর দশকে যখন অনেক বড় বড় বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট রাজনীতির ওপর অনাস্থা জানিয়ে পার্টি ছেড়েছিল তখনও কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামাল অবিচল চিত্তে, মনোবলে নেত্রকোণার পার্টিকে আকড়ে ধরে ছিলেন। জীবনের শেষদিনে পর্যন্ত তিনি কমিউনিজমের চর্চা ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আপসহীন থেকেছেন। তিনি ২০০৮ সালে ৮ম সম্মেলন, ২০১২ সালে ৯ম সম্মেলন, ২০১৬ সালে ১০ম সম্মেলনে পর পর তিনবার সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সিপিপি জাতীয় পরিষদ সদস্য, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-খনিজ সম্পদ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির জেলা আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম। তিনি মার্কসের দাস ক্যাপিটাল ১ম খণ্ড পূর্ণাঙ্গ এবং ২য় খণ্ড (প্রায়) বাংলায় অনুবাদ করেন। তাঁর আরেকটি মানবীয় বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, কারও সঙ্গে রাজনৈতিক মত পার্থক্য থাকলেও তার সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করতে হবে কিংবা খারাপ ব্যবহার করতে হবে, সেটা তিনি পছন্দ করতেন না। এই মানবীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল যা সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। তিনি জেলা কমিটিতে যোগদানের পর থেকেই জেলা পার্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামালের কর্মজীবন শুরু হয় হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে (১৯৭৮-৭৯)। তিনি ১৯৭৯ সালে ২০ জুন নেত্রকোনা মহিলা কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। উক্ত কলেজটি ১৯৯০ সালে সরকারিকরণ করা হয়। পরে তিনি সরকারি জাহেদা শফির কলেজ, জামালপুর, অর্থনীতি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে নেত্রকোণা সরকারি কলেজে যোগ দেন। ২০০৫ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে অর্থনীতি বিভাগ থেকে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামাল ১৯৮৭ সালে বিয়ে করেন কোহিনূর বেগমকে। কোহিনূর বেগম মোহনগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত ও রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। তাঁর পিতা সৈয়দ গেদু মিয়া হাওর অঞ্চলের কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন। নেত্রকোণার নারী প্রগতি আন্দোলনে তাঁর অবদান অপরিসীম। তিনি নেত্রকোনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। মেয়ে সিফাত স্বর্ণ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ থেকে অনার্সসহ এম.এস.এস করেছেন। ছেলে ঈদ ই আমীন অনন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অনুষদে ৪র্থ বর্ষে অধ্যয়নরত। তারা দুজনই ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং সিপিবির মেম্বার। কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামাল ২০০৭ সালে ২ অক্টোবর নেত্রকোণা আদর্শ শিশু বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। শিশুদের জন্য ছিল কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামালের অপরিসীম ভালবাসা। অধ্যাপক মোস্তফা কামাল মনে করতেন আমাদের ধনবাদী তথা পুঁজিবাদী বিকাশ অর্থনীতির মূল পথে অগ্রসর হচ্ছে না। এর বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়েছেন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। নেত্রকোনায় প্রতিষ্ঠা করেন একাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। সবগুলো সংগঠনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কয়েকটি সংগঠন জাতীয়ভাবে ব্যাপক পরিচিত। সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম – গ্রন্থ আলোচনা সংসদ, ঋতম্বর, সাহিত্য সমাজ। তিনি নেত্রকোনা উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। তাছাড়া নেত্রকোনা জেলা মহিলা পরিষদের অন্যতম শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি রাতে আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামালকে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতলে নিয়ে যাওয়া হলে, ৯টা ১০ মিনিটে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন চিরঞ্জীব এই বিপ্লবীকে। অধ্যাপক মোস্তফা কামাল শুধু একজন শিক্ষাবিদ কিংবা রাজনীতিক অথবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিভৃতচারী, নীতিবান মানুষ। আজীবন কমিউনিস্ট কমরেড অধ্যাপক মোস্তফা কামাল এর মৃত্যু আমাদের জন্য এক বিশাল আঘাত। তাঁর মৃত্যুতে নেত্রকোনার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে ক্ষতি ও শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা কিছুতেই পূরণীয় নয়। লেখক : সভাপতি, যুব ইউনিয়ন, নেত্রকোণা জেলা কমিটি
 

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।