বিবিসি জরিপে বাংলাদেশের সেরা অদম্য মা নেত্রকোণার সীমা সরকার

বিশেষ প্রতিনিধি: মা! ছোট্ট একটি শব্দ! কিন্ত এর শক্তি সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর কঠিন এবং বড় কাজ গুলো মাতৃ শক্তি বলেই হয়ে থাকে। মা’কে নিয়ে সারা বিশ্বে নানান রকম কথা রয়েছে। এই মহৎ, শ্বাশত চরিত্রে কোনো কালিমা নেই। নেই কোনো রকম অপবিত্রতা। এদেশে অনেক রত্নগভা মা আছেন। তাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন দেশ মাতৃকার ইতিহাসও। তেমনই এক মহিয়সী বাংলাদেশি মা নেত্রকোণার সীমা সরকার। সম্প্রতি ছেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এর এ ভাইরাল হওয়া ছবিটি বিবিসির জরিপে একশ’ মা বা মহিলার মাঝে ৮১তম হয়। বিবিসি এই জরিপে বাংলাদেশের সেরা মা, নেত্রকোণার সীমা সরকার।
ঘটনারটির বিশেষত্ব হলো, এই সীমা সরকার তাঁর শারীরিক প্রতিবদ্ধী ছেলে হৃদয় সরকারকে নিয়ে জীবনের প্রতিটি পদে পদে যুদ্ধ করে চলছেন। সাধারত, এধরণের ছেলে- মেয়ে কোনো পরিবারে হলে ওই সন্তানটিকে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি তাঁর সন্তানকে নিয়ে থেমে যাননি। সফলভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে তোলপাড় হয় বিভিন্ন মাধ্যমে।
এরপর বিবিসির জরিপে একশ’ মা বা মহিলার মাঝে ৮১তম হয়েছেন নেত্রকোণার এই সীমা সরকার। এই তালিকায় আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মেয়ে চেলসি ক্লিনটন, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড ও পাকিস্তানের প্রথম হিন্দু নারী সিনেটর কৃষ্ণকুমারীর মতো বিশ্ববিখ্যাত নারীরাও।
প্রতিটা সন্তানের জীবনেই মায়ের ভূমিকাই বেশি। মা তাঁর সন্তানকে পেটে ধারণ থেকে শুরু করে ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত এবং পরেও লালন-পালন করেন। সন্তানও মাকে সম্মান করে থাকে। বিবিসির জরিপে যিনি একশ’ মা বা মহিলার মাঝে ৮১তম। নেত্রকোলার পৌরসভাধীন কুড়পাড় এলাকার সীমা সরকার। সন্তÍানের স্বপ্ন পূরণের যুদ্ধা মা সীমা সরকার।
এ প্রসঙ্গে সীমা রানী বলেন, জন্ম থেকেই হৃদয় প্রতিবন্ধী। তার রোগের নাম সেরিব্রাল পালসি। ছেলেকে চিকিৎ্সা করিয়েছেন, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। ভালো চিকিৎসা নেই। এ অবস্থায় এই সন্তানকে মানুষ করার জন্য তিনি দৃঢ প্রতিজ্ঞা করেন। তার প্রতিজ্ঞা ছিল, যেকোনো উপায়ে তিনি ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলবেন। বাসায় পড়ানোর পাশাপাশি তাকে স্কুলে কিভাবে ভর্তি করানো যায়, সেই ভাবনা তাঁকে পেয়ে বসে। তিনি হৃদয়কে নেত্রকোণা শহরের মোক্তারপাড়া হলি চাইল্ড একাডেমিতে প্রথমে ভর্তি করান। সেখান থেকে সমাপনী পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার পর হৃদয় সরকারকে নেত্রকোণা শহরের আঞ্জুমান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ট শ্রেণিতে ভর্তি করান। সেখান থেকে হৃদয় ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় (৪.০৬) পেয়ে পাশ করে। পরে তাকে নেত্রকোণা শহরের আবু আব্বাস ডিগ্রী কলেজে ভর্তি করান। আবু আব্বাস ডিগ্রী কলেজ থেকে ২০১৮ সালে এইচএসসি পাশ করে। এই পর্যন্ত সীমা সরকারকে সীমাহীন কষ্ট করতে হয়েছে। কোলে করে স্কুলে নেয়া, ক্লাসে বসানোসহ সব তাকেই করতে হয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে কলেজের শিক্ষক এবং অধ্যক্ষ তাঁদের এ ব্যাপারে সহায়তা করেছেন।
গল্প এখানে শেষ নয়। আবারো তিনি ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঢাকায় যান তখন ভিন্নরূপে আবির্ভূত হন তিনি। ‘খ’ ইউনিটের পরীক্ষা। কলা অনুষদে পরীক্ষা দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে যখন হৃদয়কে নিয়ে যখন পৌঁছালেন তখন রিকশা থেকে নেমে ছেলেকে কোলে তোলে নিলেন। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী তাঁদের সাহায্য করতে চাইলেও তিনি তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছা, আমার ছেলেকে আমি নিজে পরীক্ষার হলে বসাবো।’ কলা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. আবু দেলোয়ার হোসেনের নিকট অনুমতি নিয়ে ছেলের পরীক্ষা কেন্দ্রের কাছে বারান্দায় থাকতে পেরেছিলেন বলেও সীমা জানান।
বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায় মেরিট লিস্টে হৃদয় সরকারের স্থান ৩০৪৭। কিন্তু ভর্তির জন্য ফরম তুলতে গিয়ে বাঁধে যত বিপত্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীদের কেবল ভর্তির সুবিধা রয়েছে। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধীর জন্য কোনো কোটা নেই ! এ নিয়ে শুরু হয় মিডিয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,সুশীল সমাজ বেশ কথাবার্তা । সর্বশেষ ৯ নভেম্বর সিনেটের সভায় এই আইন সংশোধন করে তাকে(হৃদয়কে) ভর্তির সুযোগ করে দেয়া হয়। এজন্য হৃদয়ের মা সীমা সরকার সিনেট ও মিডিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
সন্তানকে নিয়ে যুদ্ধা এই নারী বলেন, ‘সন্তানের জন্য কোনো মায়েরই কষ্ট হয় না। আমার তো আরো হয়নি, কারণ আমার ছেলে প্রতিবন্ধী। তাকে তো বেশি যত্ন করতে হবে। আর আমি অদম্য এক যুদ্ধা মা। সন্তানের লেখাপড়ার জন্য আমার স্বপ্নপূণের জন্য আমি এ কষ্ট কিছুই না। প্রয়োজনে আমি আরো কষ্ট করবো। বিশ্ববিদ্যালয়ে হৃদয় যেদিন ভর্তি হবে সেদিন বুঝবো আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হয়েছে। আমি সেদিনের অপেক্ষায় রয়েছি।’
সম্প্রতি বিবিসির করা জরিপে বিশ্বের ১০০ অনুপ্ররণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন নেত্রকোণার সীমা সরকার। সন্তানের শিক্ষার জন্য তিনি কখনোই পিছপা হননি। হবেনও না।
বিশ্বের ৬০টি দেশের ১৫ থেকে ৯৪ বছর বয়সী বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীদের নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বিবিসি অনলাইনে ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিশ্বের ১০০ জনের মাঝে তাঁর নাম শুনে তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমি এতকিছু বুঝি না। তবু একজন মা বা মহিলা হিসেবে এই নাম শুনতে অনেক ভালো লাগে। আমার ভবিষ্যত কাজের অনুপ্রেরণা এই স্বীকৃতি। এই তালিকায় আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মেয়ে চেলসি ক্লিনটন, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড ও পাকিস্তানের প্রথম হিন্দু নারী সিনেটর কৃষ্ণকুমারীর মতো নারীরা।
হৃদয় সরকারের মা সীমা রানী সরকার আরো বলেন, ‘তাঁর স্বামী ইটভাটার ম্যানেজার। টানা পোড়েনে চলে সংসার। এই অবস্থার মাঝে হৃদয়ের জন্ম হয় ২০০০ সালে। জন্ম থেকেই সে শারীরিক প্রতিবন্ধী। জন্মের পর তাঁকে অবহেলা করিনি। হতাশ হইনি। স্বপ্ন দেখেছি তাকে নিয়ে, কষ্ট করেছি, তাই হয়তো তাঁর সফলতা দেখে যেতে পারবো। সব কৃতিত্ব মায়ের।
হৃদয় সরকার বলেন, আমার স্কুল থেকে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পেছনে সবকিছুই মায়ের কৃতিত্ব। মা আমাকে বলেন, তুমি লেখাপড়ার জন্য যতদূর যেতে চাও আমি সবটুকই করবো। মা তা-ই করে যাচ্ছেন।’ ‘দেশ সেবা করার জন্য এটা একটা বড় ক্ষেত্র। ডিপ্লোমেট হওয়ার আনন্দই আলাদা। দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বাইরে দেশকে তুলে ধরা যায়।’ এই সাবজেক্টে ভর্তি হতে তাকে এ ব্যাপারে সহায়তা করবেন বলে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডিন সাদেকা হালিম আশ্বাস প্রদান করেছেন বলেও জানান হৃদয়। শারীরিক সমস্যা এই ব্যাপারে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে কি-না জানতে চাইলে হৃদয় বলেন, ‘না তা করবে না। ডিপ্লোমেট হচ্ছে মেধার বিষয়, গায়ের জোরের কিছুই না।’ যদি তিনি এই সাবজেক্টে ভর্তি হতে পারেন, তাহলে সে পড়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। হৃদয়ের আর এক ছোট ভাই আছে। তার নাম অন্তু সরকার। সে নেত্রকোণা আঞ্জুমান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র, তবে সে স্বাভাবিক।
নেত্রকোণা জেলা সূজন (সু-শাসনের জন্য নাগরিক) সভাপতি শ্যামলেন্দু পাল জানান, বিবিসিকে ধন্যবাদ। বিবিসি’র আগে দেশের সরকারী/বেসরকারী অনেক প্রতিষ্টান আছে, যারা এই অদম্য নারীর বিষয়টি নজরে আনতে পারতেন। এখনো আহ্বান রাখবো এই পরিবারটি প্রতি সরকারী/বেসরকারী পর্যায় থেকে দৃষ্টি দেয়ার জন্য।
নেত্রকোণা রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি প্রফেসর ননী গোপাল সরকার বলেন, এরকম একজন অদম্য নারীকে সম্মানীত করা মানে দেশকে সম্মানীত করা। এনিয়ে দেশের গণমাধ্যম,সরকারী/বেসরকারী পর্যায়ে আরো তুলে ধরা যেতে পারে। এরকম একজন মা-ই হতে পারেন সমাজের দেশের অনন্য দৃষ্টান্তা। তাঁকে দেখে সমাজের পিছিয়ে পরা শারীরিক প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকগণ আরো উৎসাহ পাবেন। আমি এই মাকে এবং বিবিসিকে ধন্যবাদ জানাই।
নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক মঈনুল ইসলাম বলেন,মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন জাতীয় দিবসের নিমন্ত্রণ পত্রে প্রতিবন্ধীদের আঁকা ছবি দিয়ে থাকেন। এতে করে তাদেরকে উৎসাহিত করা হয়। হৃদয় সরকার সমাজের অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। অনেকেই আছেন যারা প্রতিবন্ধি সন্তান হলে তাদের আশা ছেড়ে দেন। পড়াশুনা শিক্ষাদীক্ষায় তাদের গুরুত্ব দেয়া হয়না। এক্ষেত্রে হৃদয় সরকার এবং তার মা অনন্য উদাহণ। দেশের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা অভিভাবকগণ বুঝতে সক্ষম হবেন হৃদয়ের এই সাফল্যে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘হৃয়ের লেখাপড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চলাফেরার জন্য একটি ব্যাটারী হুইল চেয়ার প্রদান করা হবে।’

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।