একজন বিপ্লবীর সান্নিধ্যে -কমরেড আনোয়ার ফকির

১৯৮৪ সনে আমি নবম শ্রেনীতে পড়ি, হঠাৎ একদিন কর্ণপুরের এরশাদ মামা আমার ক্লাসে এসে উপস্থিত। আমি অবাক, ব্যাপার কি! তখন ক্লাস নিচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক আব্দুল ওয়াহেদ খাঁন। স্যারের সঙ্গে কথা বলে, এরশাদ মামা তার বক্তব্য শুরু করেন। শ্রেনী ও শোষনের কথা নিয়ে তিনি দীর্ঘসময় বক্তব্য দিলেন। আরও বললেন তা বাস্থবায়ন করতে হবে একটি বিপ্লবি রাজনৈতিক দলের মধ্য দিয়ে। একথা বলে, তিনি পাঁচ টাকার কূপন দিয়ে, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য বানালেন আমরা ক-জনকে। ১৯৮৭ সন ৩৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ৪র্থ তলা বাসদের প্রধান কার্যালয়ে আমি যাই। দলের নেতা কমরেড আ.ফ.ম মাহাবুবুল হক (মাহাবুব) ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য, আমার পরিচয় নিলেন বসতে বললেন, দীর্ঘক্ষন আলোচনা করার পর বললেন জোটের মিটিং আছে আশ্বাদ মিলনায়তনে চলো যাই। তিনি আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন, মাহাবুব ভাই আমাকে রাস্তায় বললেন বিপ্লব ছাড়া উপায় নাই। তুমি ভালভাবে পড়াশুনা করো এবং মেহনতি মানুষের মুক্তির কাজটা চালিয়ে যাও। আশ্বাদ মিলনায়তনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে মিটিং শুরু হলো,মনে হয় যেন, সকলেই মাহাবুব ভাইয়ের অপেক্ষায় ছিলেন। আমিও মাহাবুব ভাইয়ের সঙ্গে বসলাম। আমি যতটুকু বুঝতে পারলাম, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মিটিং, মিটিং শেষে মাহাবুব ভাই আমাকে বললেন তুমি বঙ্গবন্ধু এভিনিওতে চলে যাও আমি দশটার পরে আসব। ৯০ এর প্রথম দিকে পার্টির কাজে আমি ঢাকা যাই। মাহাবুব ভাইয়ের সঙ্গে অনেক কথা হয়, সর্বশেষে তিনি বললেন স্বৈরশাসক এরশাদকে যে ভাবেই হউক পতন ঘটাতে হবে। তোমরা কেন্দ্রীয় নির্দেশ অনুযায়ী স্ব-স্ব জেলায় কাজ চালিয়ে যেও। ১৯৯২ জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে স্থানীয় কমরেডদের নিয়ে এক মিটিং এ বসি, এতে উপস্থিত ছিলেন এরশাদুজ্জামান এরশাদ। মিটিংয়ের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল, বাসদের উদ্যেগে ফকিরের বাজারে একটি জনসভা করা। দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো, আমরা যদি কেন্দ্রীয় অনুমতি পাই তাহলে জনসভা করব।এরশাদুজ্জামান এরশাদ বললেন কেন্দ্রীয় অনুমতি নেওয়ার দায়িত্ব আমার। আনোয়ার আর আমি কালকেই ঢাকা চলে যাব। আমরা দু-জন ঢাকা কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়ে পৌঁছি, তখন রাত ০৮.০০, দলের প্রধান কমরেড আ.ফ.ম মাহাবুবুল হক (মাহাবুব) ভাই এখনও অফিসে আসেননি। কমরেড শহিদুল্লাহ্ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। ৯.০০ টার সময় মাহাবুব ভাই আসলেন তখন আমরা দু-জন তাহার টেবিলের সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি আমাদের কুশলাদি জানলেন। তারপর আমরা আমাদের আবেদনটা জানালাম। উনার চিন্তাধারাটা এতো প্রবল যে, তিনি বললেন শোষনমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষে বাংলার যেকোনো প্রান্তে যেতে আমি রাজি। মাহাবুব ভাই আমাদের আবেদনটা আন্তরিকভাবে গ্রহন করলেন। আরও বললেন আমার সঙ্গে কমরেড নির্মল সেনকেও নিতে চেষ্টা করব। কাল তোমরা দু-জনকে নিয়ে দাদার অফিসে যাব। একথা শুনে আমরা আরও খুশি হলাম। তারপর নিচে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে পার্টির অফিসে রাত্রী যাপন করি। পরদিন মাহাবুব ভাই আমরা দু-জনকে নিয়ে দাদার অফিসে গেলেন, পরিচয় করালেন নেত্রকোণার এই দুই কমরেড তাদের এলাকায় জনসভা করতে চায় তাতে আপনার যেতে হবে। দাদাও রাজি হলেন। দাদার অফিসে বসে জনসভার তারিখ নির্ধারন করা হয় ১৩ই মার্চ ১৯৯২। তারপর আলোচনা শেষে আমাদের অফিসে চলে আসি। মাহাবুব ভাই আরও বললেন তোমরা এলাকায় গিয়ে সকল কমরেডদের নিয়ে সভার প্রস্তুুতি নিতে থাক। এলাকায় এসে যাদের নিয়ে আমি কাজ শুরু করি, তারা হচ্ছেন কমরেড আবু তাওহীদ তালুকদার শামিম (১) খন্দকার গোলাপ মিয়া (২) আবু সাঈদ আহম্মেদ (৩) শ্যামল সরকার (৪) আব্দুল হাই (৫) সিরাজ মিয়া (৬) আবুল হাসিম (৭) আলী উসমান (৮) প্রমূখ। ফকিরের বাজারে জনসভার উদ্যেশে বাসদ নেতা কমরেড আ.ফ.ম মাহাবুবুল হক ঢাকা থেকে রওনা হন। কমরেডের সঙ্গে সফর সঈী ছিলেন কমরেড নির্মল সেন, কমরেড তোফাজ্জল হোসেন চৌধূরী, কমরেড মোঃ শহিদুল্লাহ্, কমরেড বিপ্লব বিজয় ঘোষ প্রমূখ। কমরেডগণ মঞ্চে এসে উপস্থিত হন। এরশাদুজ্জামানের সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হয়। দুপুর ২.০০ টা থেকে সন্ধা পর্যন্ত সভা হয়। কমরেডদের কথা শুনে এলাকার মানুষ খুব খুশি হয়। এমন কথা আর কোনদিন শুনি নাই। সভা শেষে কমরেড নির্মল সেন চলে গেলেন। কমরেড মাহাবুব ভাই সহ সকল কমরেডদের নিয়ে চলে গেলাম আমার বাড়িতে। রাতে খাওয়ার পর সকলেই শুয়ে ছিলেন মাহাবুব ভাই আমাকে নিয়ে গল্প শুরু করলেন একের পর এক। ৪৭ থেকে শুরু করলেন ৫২ এর কথা, ৬৯ এর কথা, ৭০ এর কথা, ৭১ এর কথা, তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আরও বললেন ১৯৭৩ সনে ডাকসু নির্বাচনে, আমি ভি.পি পদে প্রার্থী হই, আমার ৮০ ভাগ ভোট ছিল কিন্তুু আমার প্রতিদন্ধি শেখ কামাল ভোট বাক্স লুট করে নিয়ে যায়। আলোচনা শেষে তিন বললেন অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পর। পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে সকল কমরেডদের নিয়ে চলে গেলাম কর্ণপুর এরশাদ মামার বাড়িতে। ২০০৩ সনের মাঝামাঝি আমি খূব অসুস্থ হয়ে পড়ি, তখন মোবাইল ফোন টুকটাক শুরু হয়েছে। আমি মাহাবুব ভাইকে ফোন দিয়ে আমার অসুস্থতার কথা জানাই। তিনি বললেন বিপ্লবী অসুস্থ থাকলে বিপ্লব হবে কি-ভাবে। তুমি যত তারাতারি পারও ঢাকা চলে এসো। আমি তোমাকে ভাল ডাক্তার দেখিয়ে দিব। পরদিন ঢাকা চলে যাই, দলের অফিসে গিয়ে মাহাবুব ভাইয়ের সঙ্গে অনেক কথা হয়, তিনি আমাকে নিয়ে পিজি হাসপাতালে যান, এমনকি পরপর তিনদিন নিয়ে গেছেন। তিনি ঔষধের দোকান থেকে ঔষধও কিনে দিয়েছেন। তিনি বললেন বাড়িতে গিয়ে ঔষধ ঠিকমত খাও, তাহলে সুস্থ হয়ে যাবা। মোবাইলে যোগাযোগ রাখিও। যাক এসব কথা কমরেড আ.ফ.ম মাহাবুবুল হক ছিলেন নৈতিক, আদর্শিক, সাহসী, ত্যাগী এমন নেতা আর পাওয়া যাবে না। তাকে সর্বশেষে কু-চক্র বাহিনী গাড়ী চাপা দিয়ে মারার চেষ্টা করে কিন্তুু প্রাণে বেঁচে রইলেন কিছুদিন পর কানাডা এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি এক মেয়ে, স্ত্রী, ও লক্ষ্য গুনগ্রাহী রেখে যান।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।