যৌবন ফিরে পাচ্ছে মোহনগঞ্জের হাওরকন্যা শিয়ালজানী খাল

স্টাফ রির্পোটার: সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে। সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে, শোন মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে। মাইকেল মধুসুধন দত্ত সুদুর ফ্রান্সে বসেও ভুলতে পারেননি তার শৈশবের স্মৃতি ঘেরা সেই সাগরদারি গ্রামের কপোতাক্ষ নদের কথা। প্রতিটি মানুষেরই দুর্বল স্থান তাঁর জন্মস্থান,তাঁর গ্রাম। কখনও ভুলতে পারেনা তার গ্রাম নদ-নদী, বিল ঝিলের কথা। নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলার একটি ছোট্ট খালের নাম শিয়ালজানী। সাহিত্য সম্্রাট হুমায়ুন আহাম্মেদও তার নানার বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া শিয়ালজানী খালকে নিয়ে শৈশবের স্মৃতি চারন করেন। শৈশবের স্মৃতি টানতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, নানার বাড়ির সামনে শয়ালজানী খাল। নানার বাড়ি বেড়াতে গেলেই ছুটে যেতাম শিয়ালজানী খালে। শিয়ালজানী খালে বড়শী দিয়ে মাছ ধরতাম। ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে ঘুড়ে বেড়াতাম।
শিয়ালজানীকে দেখে এখন কেউ কি বিশ্বাস করবে ৫ শ বছর আগে মোহনগঞ্জ উপজেলার শিয়ালজানীর উপর দিয়ে লঞ্চ, বড় বড় নৌকা ধান পাট বোঝাই করে চলাচল করতো। নারায়নগঞ্জ, ভৈরব ও ভাঁটি অঞ্চলের ধর্মপাশা, মধ্যনগর, সুনামগঞ্জ, শাল্লা,দিরাই,তাহেরপুর এসকল অঞ্চলের মানুষ মোহনগঞ্জের এ হাটে বেচা কেনা করতো। খালের পার্শ্বে এখনও একটি প্রাচীন বিষœু মন্দির, একটি মোঘল আমলের মসজিদ রয়েছে। এ দুটির নির্মানের তারিখ থেকে ধারণা করা যায় মন্দিরের নির্মানের তারিখ ৭-৮ শ বছর আাগে। আর মসজিদেও নির্মাণের বয়স ৫ শ বছর। ধারনা করা হচ্ছে খালের বয়স এ দুটি পুরা র্কীর্তির সম-সাময়িক।
বহু আগে থেকেই প্রতিটি শহর বন্দর হাট বাজার গড়ে উঠেছিল নদী ভিত্তিক। প্রতিটি অঞ্চলের পরিচিতি ছিল তার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী বা খালটি ঘিরে। যেমন সিলেটের সুরমা, চট্টগ্রামের কর্নফুলী,খুলনার রুপসা, রাজশাহীর পদ্মা,ময়মনসিংহের ব্র´পুত্র নেত্রকোণার মগড়া, আর মোহনগঞ্জের শিয়ালজানী খাল। হাওরের রাজধানী খ্যাত মোহনগঞ্জের ইতিহাস এতিহ্য খুঁজতে গেলে সর্ব প্রথম যার নাম উঠে আসবে এই শিয়ালজানী খাল।
স্বাধীনতার পর থেকেই আস্তে আস্তে অবৈধ দখলদাররা শিয়ালজানীর নাম মুছে ফেলতে শুরু করেছে। তাদের নানা উৎপীড়ন নিপিড়ন সইতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে এই হাওর কন্যা। কোন সরকারের আমলেই এ খালটিকে দখলমুক্ত করতে কেউ এগিয়ে আসেননি। ভরাট হয়ে গিয়েছিল খালটি। এ মহৎ কাজটির জন্য যিনি এগিয়ে আাসলেন তিনি মোহনগঞ্জের গর্বের সন্তান সাজ্জাদুল হাসান (প্রধানমন্ত্রির কার্যালয়ের সচিব)। এলাকাবাসীকে ডেকে জড়ো করলেন বললেন মনের কথা। আসুন সবাই মিলে খালটাকে রক্ষা করি। তার নির্দেশে দখলমুক্ত হয় শিয়ালজানী খাল। দ্রুত কাজ শুরু হয়ে যায়। পূন: খাল খনন করে ব্লক দিয়ে দুই পার বাঁধানো হয়। দুই পারে বিশ্রামের জন্য পাঁকা বেঞ্চ তৈরীসহ চলছে উন্নয়নের কাজ। খালটি আবার দখলমুক্ত হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ যেমন আনন্দিত তেমন বিস্মিত। এও কি সম্ভব ! শিয়ালজানী কেবল একটা খাল না এটা হাওরাঞ্চলের একটি ইতিহাস এতিহ্যের নাম।

অধ্যাপক যতীন সরকার বলেন, এক সময় এ অঞ্চলের মানুষকে “ভাইট্যা” বলে বিদ্রুপ করা হতো। তিনি বলেন, ভাঁটি থেকে “ভাইট্যা” শব্দের ব্যবহার। যার অর্থাৎ পশ্চাৎপদ বা পিছিয়ে পড়া। বর্তমান সরকার হাওরাঞ্চল তথা নেত্রকোণার যে উন্নয়ন করেছেন তা আগামী যে কোন সরকার শত বছরেও তা করতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। মোহনগঞ্জের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি মানিক লাল সাহা (৯৫) যিনি এ খালের যৌবন দেখেছেন, তিনি দৈনিক বাংলার নেত্রকে জানান, আমার শৈশবে দেখেছি এ খালের তীব্র শ্রোত ছিল। সপ্তাহের দুদিন হাট বসতো। শনি আর বুধবার। বুধবারে বড় হাট বসতো। বড় বড় নৌকা আর ছোট ছোট লঞ্চে করে এ খাল দিয়ে বেপারীরা হাঁটে আসতেন। আমি নিজেও নৌকা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করতাম। এ অঞ্চলের পাটের জন্য খালের পাড়ে বিহারীদের একটি পাট বাছাই কল ছিল।
শিয়ালজানীকে আপনারা কেন ইতিপূর্বে দখল মুক্ত করতে এগিয়ে আসেননি? এ প্রশ্নের জবাবে মোহনগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শহীদ ইকবাল বলেন, দীর্ঘদিন পর শিয়ালজানী একটি নান্দনিক রুপ পেয়েছে। এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন আমাদের দ্বারা সম্ভব ছিল না। সাজ্জাদুল হাসান স্যার এটাকে সম্ভব করেছেন। এখানে অনেক আর্থিক বিষয় আছে। স্যারের অবস্থান আর আমাদের অবস্থান এক না।
নেত্রকোণা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আক্তারুজ্জামান জানান, মোহনগঞ্জ শহরের গরু হাট্টা থেকে সাপমারা খাল পর্যন্ত খালটি পূণ:খনন,সংরক্ষণ ও ওয়াকওয়ে নিমার্ণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ কোটি ১০ টাকা। কংশ নদের উৎস্য মুখে স্লুইস গেইট নিমার্ণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ টাকা। মোহনগঞ্জ পৌরসভা পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচটি ব্রীজ নির্মাণ করছে। আর দু’পাড়ে ড্রেন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৮ কোটি ৪ লাখ টাকা। তিনি আরো জানান, মোহনগঞ্জের বাজারের গরুহাট্টা থেকে মাইলোড়া এলাকা পর্যন্ত স্থানে গড়ে উঠেছে দৃষ্টি নন্দন ব্রীজ। খালটির দুই পাড়েই স্লাব দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে টাইলস যুক্ত ওয়াকওয়ে। স্থানে স্থানে তৈরী করে দেয়া হয়েছে ব্রেঞ্চ। তাছাড়া লাইটিং এর ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। ২০১৬ সালের দিকে খালটি উদ্ধার করে সৌন্দর্য্য বর্ধনের প্রকল্পে গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব নেত্রকোণার কৃতি সন্তান সাজ্জাদুল হাসান।
মেহেদী মাহমুদ আকন্দ জানান, বর্তমানে খালের দু’পাড়ের ওয়াকওয়ের পাশ দিয়ে ড্রেন নির্মাণ কাজ চলছে। ড্রেনের কাজ শেষ হলে লাইটিং সহ বাকী কাজগুলো দ্রুত সমাপ্ত করার চেষ্টা চলছে। আশা করছি দ্রুত বাকি কাজ সম্পন্ন করতে পারবো।
এসময় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মো: মাহফুজুর রহমান,শিয়ালজানি খালের কাজ শেষ হলে জেলার মধ্যে আকর্ষণীয় স্থান হবে এটি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিয়ালজানি খালের মতো নেত্রকোণা শহরের মগড়া নদীকেও দৃষ্টি নন্দন করে সাজানো সম্ভব।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শিয়ালজানী খাল সর্ম্পকে মোহনগঞ্জের কৃতি সন্তান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, খালটি পূনঃ দখলের সুফল একদি মোহনগঞ্জের মানুষ পাবে। এটা খাল দখল নয়। এটা মোহনগঞ্জের অতীত,এতিহ্য দখল। তবে খালটি রক্ষা করতে সম্মিলিতভাবে এলাকাবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।
নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম বলেন, শিয়ালজানী খালকে দখলমুক্ত করতে সাজ্জাদুল হাসান স্যার এগিয়ে না আসলে আদৌ এটা সম্ভব হতোনা। খালের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য এখনও কাজ চলছে। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে মোহনগঞ্জের সৌন্দর্য্য অনেক বৃদ্ধি পাবে।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।