শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি প্রাসঙ্গিক ভাবনা-এনামূল হক পলাশ

আমাদের এই অঞ্চল কৃষি, মৎস্য ও সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল। এইসব সকল বিষয় ভূমির উপর নির্ভরশীল। ভূমির মালিকানা পরিবর্তনশীল। যদিও এটাকে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটি উদাহরণের মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব। ধরুন কোন একজন লোক দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার। তার এক খ- জমি আছে। সেই লোকটি জমি বিক্রি করে চিকিৎসার করতে হবে। এরকম পরিস্থিতিতে লোকটির ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে সেবা নিতে ভূমি অফিসে যেতে হবে। সংক্ষেপে বলা যায়, ভূমি অফিসের সেবা না নিয়ে তিনি চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন না। এই অতি মানবিক বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট।
সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর হচ্ছে ভূমি প্রশাসন। ভূমি ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়ম ও অবহেলায় সাধারণ পাবলিক প্রতিনিয়ত ব্যপক হয়রানীর শিকার হয়। একটা রাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা বিশ্লেষণ করা যায় তার আইন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, প্রশাসন ও ভূমি ব্যবস্থাপনার কাঠামোর উপর। ভূমি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কারো নজর নেই। অথচ সাধারণ পাবলিক প্রতিনিয়ত এতদসংক্রান্ত সেবা গ্রহনের জন্য নানা জটিলতায় পড়ে। রাষ্ট্রের কাঠামো ও ধারনায় ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রথম গুরুত্বপূর্ন অংশ। ভূমি প্রশাসনকে নিবর্তনমূলক সেক্টর থেকে সেবামূলক সেক্টরে রূপান্তরিত করা আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ভূমি প্রশাসনের সর্বত্র একটি শাসনমূলক কাঠামোর পরিবর্তে সেবামূলক কাঠামো চালু করবে। ক্ষমতা ও দুবৃত্তায়নের ধারণা পরিবর্তন করে সেখানে দায়িত্ব ও সেবামূলক ধারণা প্রবর্তন করা জরুরী।
ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনটি বিভাগ কাজ করে। জরিপ বিভাগ, রেজিস্ট্রেশন বিভাগ এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগ। জরিপ বিভাগে অস্থায়ী লোক নিয়োগ করে জরিপ কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। এরা যা ভুল করে তা ধরা পড়ে অনেক বছর পর। রেজিস্ট্রেশন বিভাগের মূল কাজ সম্পাদন করে বেসরকারি দলিল লেখকগণ। এদের ভুলের কারণে ত্রুটিপূর্ণ দলিল সৃষ্টি হয়। ব্যবস্থাপনা বিভাগ নির্দিষ্ট আইনের অধীনে কাজ করে। এর কাঠামো স্থায়ী। এদের কাজের ভিত্তি হচ্ছে জরিপ ও রেজিস্ট্রেশন। ত্রুটিপূর্ণ জরিপ ও রেজিস্ট্রেশনের কারণে ব্যবস্থাপনা বিভাগ জনগণকে সঠিক সেবা প্রদানে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে সকল প্রকার হয়রানি ও দুর্নীতির দায় ব্যবস্থাপনা বিভাগকে নিতে হয়। অথচ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে সুনির্দিষ্ট আইন, বিধি এবং জরিপ ও রেজিস্ট্রেশনের উপর ভিত্তি করে কাজ করতে হয়। ব্যবস্থাপনা বিভাগের নিজস্ব কোন মতামত বা সিদ্ধান্ত প্রয়োগের সুযোগ নাই। যেহেতু ব্যবস্থাপনা বিভাগের কাঠামো স্থায়ী এবং এটি সর্বশেষ সেবাদাতা সেহেতু সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির দায় এর উপর বর্তায়। ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করতে এবং জন হয়রানি রোধ করতে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে একই ছাতার নীচে নিয়ে আসা সময়ের দাবি। স্বাধীনভাবে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে অবশ্যই ভূমি ব্যবস্থাপনা সকল কলংক থেকে মুক্তি পাবে। এ বিষয়ে আরো অধিক গবেষণা প্রয়োজন।
পৃথিবীর ইতিহাসে সভ্যতার উত্থান ঘটাতে ভূমি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন একটি অন্যতম নিয়ামক। ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের সাথে সাথে রাষ্ট্র তথা সমাজ ও মানবিকতার বিকাশ ঘটে। ভূমির সাথে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে মানবিক রূপ দেয়া আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। আমরা যদি ভূমি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাতে পারি তবে তা অবশ্যই সভ্যতা বিকাশের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ, ভূমির সাথে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের সম্পর্ক জড়িত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন মান উন্নয়ন ঘটলে জাতি হিসেবে আমাদের মাথা উঁচু হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে সামন্তবাদী ধারণার একটি সম্পর্ক আছে। পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। আধুনিক যুগ এসে সামন্তবাদকে বিদায় জানিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে ভূমি ব্যবস্থাপনায় সামন্তবাদ ক্রিয়াশীল আছে। এর কারণ হচ্ছে, বিগত উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা টিকে থাকার জন্য সামন্তবাদকে লালন করে আসতেছিলো। প্রকাশ্যে উপনিবেশিক ব্যবস্থা পরাস্ত হলেও তাদের সৃষ্ট তন্ত্র চালু থাকায় তা এখনো ভূমি ব্যবস্থাপনায় চালু আছে। ফলে ভূমি ব্যবস্থাপনা আর সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে নি। এই বিশ্লেষণ আমাদের সার্বিক অবস্থাকে নির্দেশ করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থা হতে উত্তরণের উপায় কি? যেহেতু অবস্থা চিহ্নিত করা গেছে সেহেতু উত্তরণের পথে বাধা সমূহ নিজ নিজ গুণে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
একজন ভূমি কর্মচারীকে তার রুটিন কাজ ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তা হলো জনসাধারণের সাথে সদ্ব্যবহার করা ও তাদেরকে হাসিমুখে বিদায় দেয়া। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত এসব ভূমি সৈনিককে সরকারী জমি স্বার্থে অতন্দ্র প্রহরীর মত ভূমিকা রাখতে হয়। তাদেরকে প্রতিদিন চোর, ডাকাত, আইনের লোক, খুনী, রিক্সাচালক, পাজেরোর মালিক, দিনমজুর, কুলি, জুয়ারী, কোটিপতি, সরল, কুটিল, কবি, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, মাওলানা, রাজনীতিবিদ, তরুণ, যুবক,সিনিয়ন সিটিজেন, পুরুষ, নারী, বিত্তবান, অসহায় ইত্যাদি হাজারো রকমের মানুষের সাথে মিশতে হয়। একক পাবলিকের স্বভাব একেকরকম। কিন্তু সকলের সাথে ভদ্র, মার্জিত, ও সুন্দর ভাষায় কথা বলতে পারাটাই একজন ভূমি কর্মচারীর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। কাজগুলি করতে গিয়ে একজন ভূমি কর্মচারীর যে সকল আর্থিক ও শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পদ মর্যাদা থাকা উচিত তার কোনটাই বিদ্যমান বেতনস্কেল ও নিয়োগবিধিতে নেই এ কথা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য। বর্তমানে দেশের বিচারালয়ে বিচারাধীন প্রায় ৮০% মামলার উৎপত্তি ভূমি কেন্দ্রিক। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ভূমি বিষয়ক যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত ভূমি সহকারী কর্মকর্তা/ উপ সহ:কর্মকর্তাগণের প্রেরিত প্রস্তাব/প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। তাই ভূমি কর্মচারীকে হতে হবে শিক্ষিত, দক্ষ ও কর্মতৎপর। তা না হলে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ভুল হতে বাধ্য। ভুমির কর্মচারীর চোখ দিয়ে রাষ্ট্র/সরকার ভূমিকে দেখে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমি শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা সময়ের দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকার বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ব বিদ্যালয়ে ডিপার্টমেন্ট খোলে পাঠ দান করা হয়। কৃষি, স্বাস্থ্য, বস্ত্র, শিল্প, সাহিত্য, প্রকৌশল, আইন সহ আরো অনেক বিষয়ের শাখা প্রশাখা নিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলেও ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যপক পড়াশোনা বা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ আমাদের দেশে নেই। স্কুল অব ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এর অধীনে ভূমি শিক্ষা চালু করা হলে রাষ্ট্রে একটি ভূমি সেবা বিষয়ক দক্ষ জনবল তৈরী হওয়া সম্ভব। পাশাপাশি মানুষের এ বিষয়ে অজ্ঞতা দূর হয়ে সেবা প্রাপ্তির অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করবে।
বর্তমানে নেত্রকোণায় শেখ হাসিনা বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম চলমান আছে। আমাদেরকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দেয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সচিব সাজ্জাদুল হাসান মহোদয়ের নিকট আমরা কৃতজ্ঞ। সেই সাথে নব নিযুক্ত ভিসি রফিক উল্লাহ খান স্যারকে গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাওর বেষ্টিত একটি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে স্বাগতম জানিয়ে নবগঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি ডিপার্টমেন্ট খোলে কল্যাণময় একটি শিক্ষা মাধ্যম চালু করার জন্য বিনয়ের সাথে দাবী করছি। শুরু হউক ইতিহাসের নতুন মাইল ফলক।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।