টানা ৬১ ঘণ্টায় ১৮৫ কি.মি সাঁতরে বিশ্ব রেকর্ড ভেঙেছেন নেত্রকোণার জলমানব ক্ষিতীন্দ্র

বিশেষ প্রতিনিধি: বিশ্ব রেকর্ড গড়ার লক্ষে প্রখ্যাত সাতারু ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যের ১৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দূর পাল্লার একক সাঁতার প্রদর্শনী সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। ৩ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল ৬টায় শেরপুরের নালিতাড়ি উপজেলার ভোগাই নদীর ব্রিজ থেকে সাঁতার শুরু করেন তিনি। বিরামহীন ভোগাই, নেতাই, কংস ও মগড়া নদী পাড়ি দেয়ার পর বুধবার রাত ৮টায় মোট ৬১ ঘণ্টায় তিনি ১৮৫ কিলোমিটার নদীপথ সাঁতরে অতিক্রম করেছেন। নেত্রকোণার মদন উপজেলার দেওয়ান বাজারে মগড়া নদীর ঘাটে এ প্রদর্শনী শেষ করেছন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সাতারু ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য গত বছরের (২০১৭) আগস্ট মাসে মাত্র ৪৩ ঘন্টায় ১৪৬ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এবার নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙেছেন তিনি।
৬৭ বছর বয়সী প্রবীণ এ সাঁতারু জানান, গিনেজ রেকর্ড বুকে স্থান পেতে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন তিনি। বিরামহীন সাঁতার প্রদর্শনী চলাকালে এক মিনিটের জন্যও কোথাও থামেননি। নদীতে সাঁতার অব্যাহত রেখেই গ্রহণ করছেন তরল জাতীয় খাবার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যের বাড়ি নেত্রকোণার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে। বর্তমানে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের এএনএস কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। ১৯৭০ সালে সিলেটের ধুপাদীঘি পুুকরে সাঁতারু অরুণ কুমার নন্দীর বিরামহীন ৩০ ঘন্টার সাঁতার প্রদর্শনী দেখে তিনি সাঁতারে উদ্বুদ্ধ হন। পরে একই বছর মদনের জাহাঙ্গীরপুর উন্নয়ন কেন্দ্রের পুকুরে ১৫ ঘন্টার সাঁতার প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে প্রথম আলোচিত হন।
পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশন পুকুরে ৩৪ ঘন্টা, সুনামগঞ্জের সরকারী হাইস্কুলের পুকুরে ৪৩ ঘন্টা, ১৯৭৩ সালে ছাতক হাইস্কুলের পুকুরে ৬০ ঘন্টা, সিলেটের এমসি কলেজের পুকুরে ৮২ ঘন্টা এবং ১৯৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথহলের পুকুরে ৯৩ ঘন্টা ১১ মিনিট বিরামহীন সাঁতার প্রদর্শন করে জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করায় ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ডাকসুর উদ্যোগে ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭৬ সালে তিনি জগন্নাথ হলের পুকুরে ১শ ৮ ঘন্টা ৫ মিনিটব্যাপী সাঁতার প্রদর্শন করে পুরাতন রেকের্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের পুকুরে পাড়ে একটি স্মারক (ফলক) নির্মাণ করে।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ঢাকা স্টেডিয়ামের সুইমিং পুল, মদন উপজেলা পরিষদের পুকুর এবং নেত্রকোণা পৌরসভার পুকুরে তাঁর একাধিক সাঁতার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারতেরও দূরপাল্লার সাঁতার প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন তিনি। ১৯৮০ সালে মাত্র ১২ ঘন্টা ২৮ মিনিটে মুর্শিদাবাদের ভাগিরথী নদীর জঙ্গিপুর ঘাট থেকে গোদাবরী ঘাট পর্যন্ত ৭৪ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দেন তিনি।
সাঁতার প্রদর্শনী ও রেকর্ড সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে গণভবনে ডেকে রূপার নৌকা উপহার দেন। একই বছর ডাকসু তাঁকে বিশেষ সম্মাননা সূচক স্বর্ণপদক দেয়। এছাড়াও জগন্নাথ হল কর্তৃপক্ষ দুই বার এবং শামছুন্নাহার হল কর্তৃপক্ষ একবার তাকে সংবর্ধনা ও স্বর্ণপ্রদক প্রদান করে। এছাড়াও বহু সংগঠন পুরস্কৃত করে তাঁকে।
আমেরিকার সাঁতারু ডায়ানা নাঈদের ২০১৩ সালে কিউবা টু ফ্লোরিডার ১শ৭৭ কিলোমিটার দূরপাল্লার সাঁতারের বিশ^রেকর্ড ভাঙতে গত ৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৭ ঘটিকায় শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই ব্রিজ থেকে সাঁতার শুরু করেন। ভোগাই, কংস নদী ও মগড়া নদী হয়ে টানা ৬১ ঘন্টা সাঁতার কাটার পর রাত ৮ ঘটিকায় নেত্রকোণার মদনের মগড়া নদীর দেওয়ান বাজার ঘাটে পৌঁছান। এ খবরে দুপুর থেকেই হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু মগড়া নদীর বিভিন্ন ঘাটে ও আনাচে কানাচে অপেক্ষা করতে থাকে। তাকে দেখেই উল্লাসে ফেটে পড়ে তারা।
সাতাঁরুর ভাগনে বিমান বৈশ্য জানান, গত সোমবার সকাল ৭টা ১০ মিনিটে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীর ওপর নির্মিত সেতুর পশ্চিম প্রান্তর থেকে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার শুরু করেন ৬৭ বছর বয়সী এই সাঁতারু। এর আগে সেখানে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে এ সাঁতার কার্যক্রম উদ্বোধন করেন নালিতাবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুর রহমান। এ সময় নালিতাবাড়ী পৌরসভার মেয়র আবু বক্কর সিদ্দিক, নেত্রকোণা জেলার মদন পৌরসভার সাবেক মেয়র মোদাচ্ছের হোসেন শফিক, নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল হোসেন মাস্টার, বাঘবেড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সবুর, নেত্রকোনার মদন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল কুদ্দস, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মদন শাখার সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আজহারুল ইসলাম হিরু,মদন নাগরিক কমিটি এবং নালিতাবাড়ী প্রেস ক্লাব নেতৃবন্দ উপস্থিত ছিলেন। ভোগাই নদীর দুই পাড়ে শত শত দর্শনার্থী হাত নেড়ে ক্ষিতিন্দ্রকে স্বাগত জানায়। এ সময় তাঁর নাম ধরে চিৎকার করে তাঁকে উৎসাহিত করতে থাকে। মদন উপজেলা নাগরিক কমিটি ও নালিতাবাড়ী পৌরসভা এ সাঁতার অনুষ্ঠানে ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যকে সার্বিক সহায়তা করেছেন।


সাতাঁরু ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার এক নারী সাঁতারু ১শ৭৭ কিলোমিটারের রেকর্ড ভঙ্গ করতে আমার এ সাঁতারে নামা। ২০১৭ সালে ৪ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে ৬ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত ১শ৪৬ কিলোমিটার নদীপথে সাঁতার কেটেছিলেন ক্ষিতীন্দ্র। এবার আরও ৩৯ কিলোমিটার পথ বাড়িয়ে ১শ ৮৫ কিলোমিটার নদীপথে সাঁতার কেটে সফল হয়েছেন এ মুক্তিযোদ্ধা।
মদন উপজেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক (সাবেক মেয়র) দেওয়ান মোদাচ্ছের হোসেন শফিক জানান, এই কৃতি সাঁতারোর ১৮৫ কিলোমিটার বিরামহীন সাঁতারের রের্কড রাখতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারিখ ও সময় নির্ধারিত ভিডিও ক্যামেরায় ভিডিও ফুটেজ রাখা হয়েছে। এই সাঁতারে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের তিনি উপজেলা নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান।

486,7224,808,1106,103,1024,842,811,907,31631,1250

উল্লেখ্য যে,মদন উপজেলা নাগরিক কমিটি ও নালিতাবাড়ি পৌরসভার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ সাঁতার প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন নালিতাবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুর রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নালিতাবাড়ি পৌরসভার মেয়র আবু বক্কর সিদ্দিক ও মদন উপজেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক (সাবেক মেয়র) দেওয়ান মোদাচ্ছের হোসেন শফিক।
মদন উপজেলার নির্বাহী অফিসার মোঃ ওয়ালীউল হাসান বলেন, প্রখ্যাত সাঁতারু বীরমুক্তিযোদ্ধা ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য ১শ৮৫ কিলোমিটার সাঁতার প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। গিনেজ বুকে নাম লেখাবেন বলে তিনি আশা করছেন। নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদী থেকে সাঁতার শুরু করে নেত্রকোণা জেলার কংশ ও মগড়া নদী হয়ে মদন উপজেলার দেওয়ান বাজার ঘাট পর্যন্ত ১শ৮৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পৌঁছেছেন ।
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য আমাদের দেশের গর্ব, উনাকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। গিনেস বুকে নাম লেখার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।