“মনে পরে ১৫ আগস্টের সেই কালো প্রভাতের কথা”- মোঃ শাহজাহান মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা

১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের সেই কালো প্রভাতের কথা আজও ভুলিনি, ভুলতে পারব না কোনদিন। সে ভোর ছিল ঘোর-কালো অন্ধকার। ইতিহাসের পাতায় কালো ছায়ার মতো চির অম্লান হয়ে রবে যুগ যুগ ধরে সেই প্রভাতটি। দিবসটি ছিল শুক্রবারের, ঢাকাস্থ ৮/এইচ গ্রীনরোড সরকারী কলোনিতে আািম আমার স্ত্রী-পুত্র সহ ঘুমিয়ে ছিলাম। প্রথমে ফজরের আজানের ধ্বনি তার পর পর গুড়–ম গুড়–ম এবং ট ট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। জানালা খোলা থাকায় শব্দগুলো পর্য্যায়ক্রমে স্পষ্টতর থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। আমি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথে স্ত্রী -সন্তানসহ সবাই জেগে উঠলো। আমি বাসার দরজা খুলে সিঁড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পিছু পিছু আমার স্ত্রী এলো। স্পষ্টত বুঝা গেল এই আওয়াজ ৩২ নম্বর সড়কের দিকে। মনে হলো চাইনিজ অটো রাইফেল ও স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ। কেন যেন বুকটা কেঁপে উঠলো। আমি তরিৎ বেগে বাসায় ঢুকে পিটি ড্রেস পরে ছুটে চললাম কলোনীর পশ্চিম দিক বরাবর । পিছনে পিছনে স্ত্রীর বাধা। বের হইওনা। কোথায় যাবে? সাবধান! আমি কোনও বাধা না শুনে অগ্রসর হলাম। কলোনীর পশ্চিম দিক সংলগ্ন নিউমার্কেট -মিরপুর সড়ক । পরে ধানমন্ডি লেইক এবং উত্তর/পশ্চিম দিকে অর্ধ কিলো অদুরে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রোডের বাসা অবস্থিত । গেইট পাড় হয়ে যখনই রাস্তায় পা বাড়ালাম ঠিক তখনই পেছন থেকে উচ্চ আওয়াজ ধমকের স্বরে কে যেন বলল, দাঁড়াও । আমি থমকে দাঁড়ালাম। তাকিয়ে দেখলাম প্রায় ২৫-৩০ জন কালো পোষাকধারী সেনাবাহিনীর জোয়ানেরা অ¯্রহাতে রাস্তায় পজিশান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ্।ে দুটি বড় ট্রাকে দুটি কামান, পশ্চিম ও পশ্চিম উত্তর দিকে নল উচিয়ে অপেক্ষা করছে। কয়েকজন জোয়ান আমার কাছে এসে হ্যান্ডসআপ করালো। জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলো এতো সকালে আমি কোথায় যাচ্ছি ? উত্তরে অনেকটা ভীত স্বরে বললাম আ-মি পিটি করতে এই মাঠে চলছি। রাস্তার পার্শ্বেই ধানমন্ডির খেলার মাঠ। ওরা আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখল। এমনি সময়ে একান্ত পরিচিত চেনা মুখ আবু নছর আমাকে দেখে চিনে ফেললো। সে এগিয়ে এসে বললো, উনি আমার বড়ভাই । তিনি পুলিশ অফিসার এবং এই কোয়ার্টরে উনার বাসা। তিনি আমাদের এলাকার লোক। তখনই একজন সেনা কর্মকর্তা বলে উঠালো ,উনাকে বাসায় পৌছে দাও এবং বল বাসায় গিয়ে রেডিও শুনতে । তাছাড়া উনার বাসা থেকে খাবার পানির জগ ও গ্লাস নিয়ে এসো। সেনা আবু নছরসহ তিনজন আমাকে আমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে দুটি জগ ভর্তি খাবার পানি ও দুটি গ্লাস নিয়ে চলে গেল। আমি বাসায় পৌঁছেই রেডিও অন করলাম এবং শুনতে পেলাম রুড় কন্ঠে আওয়াজ আসছে , আমি মেজর ডালিম বলছি। রেডিও বাংলাদেশ থেকে আমি মেজর ডালিম বলছ্ িসৈরাচারি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। সারা শহরে কারফিউ বলবৎ আছে। বাসা থেকে কেউ বের হবেন না। আবার শুনা গেল আমি কর্নেল ফারুক বলছি , অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের প্রধান সেনাপতি বক্তব্য রাখবেন। অল্প সময়ের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে খন্দকার মোস্তাক আহমেদ জাতির ্উদ্দেশ্যে ভাষন দিবেন। রেডিও বক্তব্য শোনার পর আর বোঝার বাকি রহিলনা যে ,আমরা কাকে হারিয়েছি। জাতি আজ কাকে হারালো ! এ যেন ঘোর অন্ধকার হয়ে গেল সেই প্রভাত। দুঃচোখ দিয়ে টলমল করে অশ্রু ঝরছে । আমি ড্রইনরুমে বিছানায় হেলান দিয়ে পড়ে রয়েছি । আমার মিসেসও কাঁদছেন। তার দুচোখে কান্নার অশ্রু ঝরছে। কিন্তু উচ্চ স্বরে আমরা কেউ কাঁদতে পারছিনা। পাশে কে কি ভাবে। বাসার প্রতিবেশিরা সবাই জেগে উঠলো। সবাই যেন আমার বাসার রেডিও শুনতে এলেন। তিনতলায় বসবাসরত পররাষ্ট্র মন্ত্রানালয়ের প্রটোকল অফিসার জনাব , হাবিবুল্লাহ সাহেবেও আমাদের বাসায় আসলেন। আমাদের বাসা নিচ তলায় সবাই জানে আমি বঙ্গবন্ধুর গনভবন, বাসভবন প্রটোকল প্রটেকশান ও পুলিশ কন্ট্রোল রুমের ওয়্যারলেস বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তাছাড়া আমার বাসা থেকে তিনজন কালো পোষাকধারী সেনা খাবার পানির জন্য আসা – যাওয়া করতে দেখে সবার চোখ আমার বাসার দিকে। সবার চোখে কান্নার অশ্রু। কিন্তু ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে কাঁদতে পারছেনা। এ এক বিরাট যন্ত্রনা। কেন এমন হলো? সবার মুখ বন্ধ। এমনি সময়ে কালো পোষাকধারী বিদ্রোহী সেনা আবু নছর এসে পানির জগ ও গ্লাস দিয়ে গেল এবং বলল ভাইজান আপনাকে জানাইতেছি যে , শেখ সাহেবের ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবত এবং ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনি সহ বাসার সবাইকে খতম করা হয়েছে। এক মাত্র শেখ সাহেবের বংশে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ব্যতিত আর কেউ বেঁচে নেই। উনারা জার্মানে থাকার কারনে এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন। আবুনছর চলে গেল। স্টাফ কোয়ার্টারে আবার অনেকে আছেন যারা বঙ্গবন্ধুর নিহতের সংবাদে খুবই খুশী। আবার অনেকে চাপাকান্নায় কেউ কোনও কথা বলছেন না। মনে হলো আজকের এই কালো প্রভাতে মুছে গেলো মহান স্বাধীনতার সূর্যের আলো। আজ থেকে মৃত্যু ঘটেছে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ,সকল মুক্তিকামী জনতার। যে মহানায়কের আহ্বানে সারা দিয়ে নিজের সরকারী চাকুরী ,নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে ,মা বাবা,স্ত্রী পুত্র, ভাই বোনদের মায়া ছেড়ে মহান মুক্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী খেয়ে না খেয়ে ,পাহাড়ে পর্বতে ,বনে জঙ্গলে ,খালে বিলে,নদী নালায় অবস্তান নিয়ে একটি মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করেছিলাম । যে মহান নেতা তাঁর সারাটি জীবন যৌবন ,জেল জুলুম উপভোগ করে এই বাংলার জন্য এই বাংলার মানুষের জন্য আত্মহুতি দিয়েছিলেন ,তাকেই যখন পাকিস্তানি সেই দোসররা জীবনে বাঁচতে দিলনা ,তখন আমাদের মতো চুনা পুটিদেরকেও ওরা শান্তিতে বাঁচতে দিবে না। ইতিমধ্যে বেলা ১২টা বেজে গেল। কেবল সকালে এক গ্লাস পানি পান করে একটার পর একটা সিগারেট টেনেই চলছি। এমনি সময়ে ছুটে এলেন আমাদের এলাকার সাংসদ জনাব হাদিছ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বঙ্গবন্ধুর সহ রাজনৈতিকবিদ এবং একজন আদর্শ ব্যাক্তিত্ব। তিনি ধানমন্ডিস্থ ১৮ নং সড়কের বাসা ব্যারিস্টার আব্দূল বাকি মল্লিক সাহেবের বাসায় অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাসার সংবাদ জানতে আমার বাসায় ছুটে এসেছেন। দুজনে নির্জনে বসে আলোচনা করছি আর চাপা কান্নায় ভাসছি। আমার মিসেস দুজনকে দুকাপ চা ও কিছু চানাচুর দিলেন। মনের জোরেই চা চানাচুর গলগ্রহ করলাম। ইতিমধ্যে দুজনেই গ্রীনরোড কলোনী মসজিদে জুম্মার নামায আদায় করলাম। বাসায় ফিরে এসে দেখলাম অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্থ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের ওয়ারলেস অপারেটর গোলাম সরোয়ার কাঁদছে। সে কান্নারত অবস্থায় বলতে লাগলো স্যার আমি আর চাকুরি করবনা। আমি আর ঢাকা থাকব না। বাড়িতে চলে যাব। না খেয়ে মরব তারপরও এমন চাকুরির প্রয়োজন নেই। ওকে দেখে বুঝা গেল সে খুবই ক্ষুধার্ত। তাকে বাথরুমে পাঠালাম গোসল করতে। সারোয়ারের ফর্সা মূখ যেন কালোবরন ধারন করছে। সারোয়ারের গোসল শেষে খাবার টেবিলে বসে আমরা কথা বলছি আর খাবার খাচ্ছি । খাবার শেষে আমরা আবার ড্রয়িংরুমে বসে সারোয়ারের সাথে কথা বলছি। সে দুপুর পর্যন্ত বিদ্রোহী সেনাদের হাতে বন্দি ছিল বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনে অবস্থিত পুলিশের ব্যারাকে। টয়লেটে যাবার ছল ধরে কোনও রকমে পালিয়ে চলে এসেছে। সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বঙ্গবন্ধুর বাসার নিহতদের বর্ণনা দিল। সারোয়ার আবার জানালো চাকুরি না করার কথা। শেষ পর্যন্ত সারোয়ার আর চাকুরি করে নাই । তার দেশের বাড়ি ছিল যশোর জেলায়। সারোয়ার বিশ্রাম নিতে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

এমপি সাহেব চলে গেলে আমি মটর সাইকেল যোগে কন্ট্রোল রুমে চলে গেলাম। দেখতে পেলাম শাহবাগস্থ রেডিও স্টেশানের সামনে দুটি ট্যাঙ্ক ও রেসকোর্স ময়দানে পাঁচটি টেঙ্ক মোতায়েন রয়েছে। ট্যাঙ্কের চালকরা সবাই কালো পোষাকধারী। ওয়ারলেস কন্ট্রোলরুমে ঢুকে এস.আই নূরুল ইসলাম সাহেবের সাথে দেখা হলো । দেখা হলো ডি.্এস.পি আব্দুল ওয়াহেদ সাহেবের সাথেও। তিনি রাতে কন্ট্রোল রুমে ডিউটিতে ছিলেন এবং ভোর বেলায় বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন রিসিভ করেন । তিনি কেবল শুনতে পান আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি। তার পরেই টেলিফোন লাইন কেটে দিল। তারপর আর যোগাযোগ সম্ভব হয় নাই। কন্ট্রোলরুমে এসে জানতে পারলাম Ñ বঙ্গভবন, টিভি সেন্টার এবং শেরেবাংলা নগরের রক্ষিবাহিনীর সদর দপ্তরের দিকে অসংখ্যক ট্যাঙ্ক ও কামান মোতায়েন রয়েছে। ট্রাক ভর্তি কালো পোষাকধারী বিদ্রোহী সেনারা কামানের নল উচিয়ে শহরের মেইনরোড গুলোতে টহল দিচ্ছে। শহরে লোক চলাচল নেই বললেই চলে। অতি জরুরী কাজে কিছু ব্যাক্তি রিকশায় চলাচল করছে।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন সূত্রে অতি গোপনে জানতে পারলাম যে, আর্টিনারি ও ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের নৈশ প্রশিক্ষনের নামে গত ১৪ ই আগষ্ট রাত দশটার দিকে কর্নেল ফারুকের নেতৃত্বে ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাঙ্ক একত্রিত করে তেজগাঁও বিমান বন্দরে । রাত ১১টার দিকে বিমান বন্দরের কাছে অবস্থিত স্কোয়াড্রন অফিসে মিলিত হয়ে অপারেশান পরিকল্পনা করে যথাক্রমে মেজর ডালিম, মেজর নুর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার , মেজর পাশা ও মেজর রাশেদ। উক্ত অপারেশান পরিচালনা করেন কর্নেল ফারুক । তবে এই পরিকল্পনার মূল নায়ক নেপথ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোসতাক আহমেদ। অপারেশান পরিচালনার জন্য তিনটি বাসাকে টার্গেট করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ,ভগ্নিপতি ও কৃষি মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এর বাসভবন এবং ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনি সাহেবের বাসভবন। অপারেশান পরিচালনার জন্য পৃথক পৃথকভাবে দায়ীত্বেও প্রদান করা হয়্। তাছাড়া ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ,বিডিআর ও রক্ষিবাহিনী যাহাতে প্রতিরোধ করতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় ট্যাঙ্ক ও কামান সহ কালো পোষাকধারী বিদ্রোহী সেনা ট্রাকে ভর্তি করে মোতায়েন করা হয়েছিল এবং সেজন্য বিদ্রোহী সেনাকর্মকর্তাদের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল। এই সকল পরিকল্পনা যাতে কিছুই জানতে না পারেন সেজন্য প্রধান সেনাপতি মেজর, জেনারেল শফিউল্লাহ , মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ, মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান এবং মেজর জেনারেল নূরুজ্জামানকে কিছুই জানানো হয় নাই বরং তাদেরকে নিবৃত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনাকারীরা তখন একমাত্র ভয় পেত বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধান খালেদ মোশারফ ও রক্ষিবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল নূরুজ্জামান সাহেবকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ব থেকে তিনটি বাসভবনের চতুর্দিক থেকে ঘিরে রাখা হয়েছিল গভীর রাত থেকেই।্ ভোর বেলায় একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাসা সহ তিনবাসা আক্রমন চালানো হয়। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আক্রমন পরিচালনা করে কর্নেল ফারুক। আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমন পরিচালনা করে মেজর ডালিম। রিসালদার মুসলেম উদ্দিনকে দায়ীত্ব দেওয়া হয় শেখ ফজলুল হক মনির বাসভবনে আক্রমন পরিচালনার জন্য।

বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমনকালীন সময়ে সারা সিড়ি ভেসে যায় রক্তে এবং দেওয়াল গুলো ঝাজড়া হয়ে যায় স্টেন গানের ব্রাশ ফায়ারে। বঙ্গবন্ধুর দেহে সর্বমোট ১৮টি গুলি বিদ্ধ হয়েছিল । মেজর হুদা ও মেজর নুর ঠান্ডা মাথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। বিদ্রোহীরা প্রথমে বঙ্গবন্ধুর বাসায় নিচতলায় শেখ কামাল সাহেবকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বাসায় একা›ত সহকারী মহিবুল ইসলাম , ডিএসপি নূরুল ইসলাম খান ,আব্দুল মতিন এসবির সহকারী দারোগা আবু বকর সিদ্দিককে রিশিপশান রুমে শেখ কামাল সাহেবের লাশের পার্শ্বে এক সাড়িতে দাঁড় করানো হয়।উনারা সবাই ঐ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কর্মরত ছিলেন। বিদ্রোহীদের একজন আবু বকর সিদ্দিককে হত্যা করে গুলি করে এবং অন্যদেরকে বিদ্রোহী পাহারাদারদের মাধ্যম আটক রাখা হয়। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসের, বেগম ফজিতুন্নেছা মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতান জামাল খুকু, পারভিন জামাল রোজিকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ছোট ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, আমীর হুসেন আমুর খালাতভাই আব্দুর নাঈম রিন্টু এবং আব্দুর রব সেরনিয়াতের ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাতকে । ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনি এবং তার অন্তসত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে হত্যা করে শেখ ফজলুল হক মনির বাসভবনে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদকে হত্যা করে সোবানবাগ মসজিদের সামনে যখন তিনি সংবাদ পেয়ে নিজ প্রাইভেট কার যোগে বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে আসছিলেন । অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক ও দুৎখজনক ,ঘাতকরা সর্বশেষে বঙ্গবন্ধুর সর্ব কনিষ্ট সন্তান শেখ রাসেল কে যখন হত্যা করে নর পিশাচরা তখন কাকুতি মিনতি করে অবুঝ সন্তানের মত কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলেছিল ,“ আঙ্কেল আল্লাহর দোহাই লাগে, আপনারা আমাকে মারবেন না। আমি আপনাদের বাড়িতে আজীবন গোলামি করব। কিন্তু পাষন্ডরা ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে। একটি লুঙ্গি দিয়ে চেপে রেখে ছিল। বঙ্গবন্ধুর ছোটভাই যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসের বলেছিলেন , আমি রাজনীতি করিনা, আমি পঙ্গু মানুষ,খুলনা থেকে ছোট খাট ব্যবসা করে জীবন কাটাই্ আপনারা আমাকে মারবেন না । কিন্তু কে শুনে কার কথা, ঘাতকরা তাকেও বাঁচতে দেয়নি। এমনিভাবে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু সহ পরিবারের সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।ঘাতকরা ১৬ আগষ্ট বঙ্গন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধুর পিতা লুৎফর রহমানের কবরের পার্শ্বে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করে এবং অন্যান্য সকলকে ১৬ আগষ্টের ভোর হওয়ার পূর্বেই বনানী কবরস্থানে দাফন কাফন করা হয় । মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ সাহেব প্রধান সেনাপতি হিসাবে থাকার পরেও তাকে পাশ কাটিয়ে একমাত্র ক্ষমতার লোভে মীরজাফর খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং তার কতিপয় বিশ্বাষঘাতক সহচর যথাক্রমে নূরুল ইসলাম মঞ্জু ,তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম ও ওবায়দুল রহমান এর একতায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পরিকল্পনা জাতির শ্রেষ্ট সন্তান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে শুধু হতিহাসকেই কলঙ্কিত করে নাই বরং সারা বিশ্বের একজন প্রতিভাবান তেজস্বী জননেতাকে হারানোর ব্যবস্থা করল। আমার বিবেকে একটি বিষয়েই নাড়াদেয় বার বার এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে এদেশের সূর্য সৈনিকদের মধ্যে একজন সৈনিকের হাতিয়ারও কি গর্জে উঠতে পারল না !! আমাদের এই মহান কিংবদন্ডী নেতার জীবন রক্ষার্থে। হায়রে বাঙ্গালী হায় । কাঁদো বাঙ্গালী কাঁদো ্ সারাটা জীবন কেঁদে যাও। বাংলা বিহার উরিস্যার নবাব সিরাজ উদ-দৌল্লাহ মরেছিলেন অত্যন্ত বিশ্বাস করে তারই ভগ্নিপতি মীর জাফর আলী খানকে প্রধান সিপাহশালার হিসাবে দায়িত্ব দিয়ে। আজ তোমারই মন্ত্রী পরিষদের সদস্য বেঈমান খন্দকার মোসতাক আহমেদ এর পরিকল্পনায় তোমারই একান্ত বিশ্বস্থ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এর গোপনীয় যোগ সাজসে তোমাকে তোমার পরিবার পরিজন সহ নির্মম ভাবে হত্যা করে আমাদিগকে নেতৃত্বহীন করে তুলেছিল। কাঁদিয়েছিল তোমারই আদর্শে গড়া দেশ প্রেমিক সূর্য সন্তানদের।

কালের পরিক্রমায় আজ বিয়াল্লিশ বছর পর সেই ১৫ আগষ্ট ফি্ের আসছে। আসছে সেই কালো প্রভাতের ৪২ তম প্রতিষ্টা বার্ষিকী যা অতিব সন্নিকটে। আজ তুমি তাকিয়ে দেখ আজকের প্রভাতে তোমারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ১৭ কোটি জনগোষ্টির রাষ্টপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী । তারই নিরলস প্রচেষ্টায় তোমার হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে এবং বিচারের ফাঁসির রায় কার্যকরী হয়েছে বাংলার এই মাটিতে । আজ তোমারই এই কন্যার প্রয়াসে একাত্তরের ঘাতক দালাল তথা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য অপরাধীদের বিচার হয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল আদালতে। অনেক রাঁয়ের ফাঁসির আদেশ কার্যকরী হচ্ছে এই বাংলায় । আজ আমাদের জাতি কলঙ্ক মুক্ত হওয়ার দ্বার প্রান্তে । আসছে ১৫ আগষ্টে কালো প্রভাত কে স্বরন করে তোরারই মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলতে চাই “যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা যমুনা গৌরি বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।