নাটোরের স্বপ্নদ্রষ্টা জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন

নাজমুল হাসান, নাটোর: বর্তমান নাটোর অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই অত্যন্ত সুপরিচিত জনপদ হিসেবে চিহ্নিত। আবহমানকালের দ্বন্ধ-সংঘাত, সুখ-শোক, আশা হতাশা আর জীবন সংগ্রামের বৈচিত্র নিয়ে আজো বয়ে চলছে এখানকার জনধারার মানস-প্রকৃতি। তারই ধারাবাহিকতায় এখানকার সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবনযাপনে রয়েছে নানা বৈচিত্র। এছাড়া রানী ভবানী, বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা, কবি জীবনানন্দের বনলতার শহর হিসাবে দেশ বিদেশে নাটোরের পরিচিতি ব্যাপক। এছাড়া সম্প্রতি দিঘাপতিয়ার রাজকন্যা কবি ইন্দুপভা দেবীর কারণে নাটোর নতুন করে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে।
পূর্ব থেকেই নাটোর একটি সম্পদশালী, সুন্দর ও অনেক সম্ভাবনাময় একটি স্থান। এখানে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে অনেক উন্নয়ন করা যেতে পারে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ণ ও বাস্তবায়নের অভাবে দীর্ঘদিন অবহেলিত থেকে গেছে উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ এই জেলা। তবে অবহেলার কিছুটা অবসান ঘটে ২০১৬ সালে। তখন জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করে শাহিনা খাতুন নাটোরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। প্রথমেই তিনি ঐতিহ্য রক্ষার ব্রত নেন। তারই প্রেক্ষিতে উত্তরাঞ্চলে প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র বাসভবন গণভবনকে নতুন করে ঢেলে সাজান। তাতে পাল্টে যায় উত্তরা গণভবন। গণভবনের অভ্যন্তরে গ্র্যান্ড মাদারস হাউজ দখলমুক্ত করা সহ ৮০ভাগ স্থান দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্তকরণ, বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে লাগানো হৈমন্তি গাছ রক্ষা, কবি ইন্দুপ্রভাদেবীর চিঠি ও কবিতাসহ রাজরাজাদের আমলের দ্রব্য দিয়ে সংগ্রহশালা, মিনি চিড়িয়াখানা নির্মাণ, বৃক্ষরোপন, পাখির অভয়াশ্রমসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নাটোরবাসীর মধ্যে আশার সঞ্চার করে। এছাড়া মূল ফটকের সামনের জায়গার জন্য যে নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে দর্শনার্থীদের থাকার জন্য হোটেল, সিনেপ্লেক্স, ব্যান্ডিং শপিংমল, লেক, বাচ্চাদের জন্য খেলার মাঠসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। অবশ্য বর্তমানে গণভবনের সামনে যে অবৈধ দোকানপাঠ রয়েছে সেগুলোর পুনর্বাসনের কথাও মাথায় রাখা হয়েছে। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে এটি হবে দেশের পর্যটন শিল্পের অন্যতম এক স্থান। এখান থেকে রাজস্ব আয় বাড়বে বহুগুন। এছাড়া বঙ্গজল রাজবাড়ির উন্নয়নেও নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
উত্তরা গণভবনের পরে জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনের চেষ্টায় নাটোরের দিঘাপতিয়া শিশু সদনের চিত্র পাল্টে যায়। দীর্ঘদিনের অবহেলিত শিশু সদনে তিনি পর্যায়ক্রমে নতুন ভবন, বাইন্ডারি ওয়াল, ডাইনিং, ট্রেনিং সেন্টার, বিছানাপত্র, দোলনা, কম্পিউটার, ট্রেনিং সেন্টার, ডাইনিং স্পেস সহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করেন। এখানেই থেমে থাকেনি তার পথচলা। নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনের জীবনের এই আলোময় দিক জানলে সবাই বিমোহিত হন। যে কেউ নিশ্চিতভাবেই এটা শুনে বিস্মিত হবেন যে, শিশু সদনে’র ৮৪জন মেয়ে জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে থাকে। এবং এটি শুধু নিছক কোন সম্বোধন নয়। মাতৃস্নেহ, আদর-ভালবাসা দিয়ে, জীবন গঠনে সহায়ক বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়ে অনুপ্রাণিত করে চলেছেন শাহিনা খাতুন। সত্যিকার অর্থেই যেন এই বালিকাদের মা’য়ের স্থান দখল করে নিয়েছেন তিনি। মমতাময়ী মা শাহিনা খাতুনও তাদেরকে নিজের সন্তানের মতই দেখেন, যেমনটি তিনি তার দুই মেয়ে তাহিয়া আনান ধীরা ও কাসফিয়া আজিজ প্রাচীর ও কাজের সহকারী চাঁদনী খাতুনের ক্ষেত্রে ভাবেন। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে সবাইকে নিয়ে হাসি আনন্দে সময় কাটানোসহ তাদেরকে পোষাক, সাজসজ্জা উপহার দেওয়ার চেষ্টা করেন। শিশু সদনের প্রতিটা শিশু প্রতীক্ষায় থাকে কখন ‘মা’ আসবেন। এতোগুলো বাচ্চাকে মাতৃস্নেহর বিষয়টি সবার নজর কারে। সবার মনের মণিকোঠায় স্থান পায় তার কোমল হৃদয়ের এই দিকটি।
জেলা প্রশাসকের কোমল হৃদয়ের আরেকটি দিক হলে অসহায় দরিদ্রদের প্রতি ভালবাসা। এবার সুধীজনদের সাথে ইফতারি না করে জেলা প্রশাসক তা তুলে দেন দরিদ্র অসহায় মানুষদের মাঝে। শাহিনা খাতুন স্বশরীরে তপ্ত রোদ উপেক্ষা করে অসহায় মানুষদের মাঝে ইফতার সামগ্রী তুলে দেন।
ডেপুটি কমিশনার, নাটোর ফেসবুক পেজে তিনি লিখেন, ‘ইফতার পার্টির নামে নিজেরা না খেয়ে এবার করলাম গরীবের জন্য ইফতার। বস্তি, গুচ্ছগ্রাম এবং স্টেশনের দরিদ্রদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। গতবছর যাদের নিয়ে একসাথে ইফতার করেছিলাম তাদেরকে নিয়ে বসিনি বলে, একেবারে খারাপ লাগছেনা না তা নয়। তবে দরিদ্র লোকজন খাবে এটা ভেবে তৃপ্তি পাচ্ছি। যেসকল কর্মকর্তা কর্মচারী রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ সুধীজন সবসময় জেলা প্রশাসনের সকল কাজের সঙ্গে থাকেন, সহায়তা করেন তাদের নিয়ে বসলাম না বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’ তার এই মহানুভবতাকে সবাই স্যালুট জানিয়েছে। এই দৃষ্টান্ত অনুসরন করে লালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নজরুল ইসলামও এতিম শিশুদের সাথে নিয়ে ইফতারের আয়োজন করেন।
এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে, লালন একাডেমি নির্মাণের মাধ্যমে তিনি সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখেন। তিনি নিজেও একজন লালন শিল্পী। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার ভরাট গলার লালনগীতি শুনে সবাই মুগ্ধ হন। কর্ম জীবনের সীমাহিত ব্যস্ততা না থাকলে তিনিও হয়ত হয়ে উঠতেন দেশখ্যাত লালন শিল্পী। পুকুর খনন যখন নাটোরে ভয়াব্হ আকার ধারণ করেছে তখন রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রশাসনের লোকজন সহ তিনি নিজেই মাঠে নামেন। একের পর এক অভিযানে রক্ষা করেন ফসলি জমি। তার নির্দেশে হালতি বিলে দ্রুত খাল খনন করে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতার অবসান ঘটে। এছাড়া স্কুলের ভর্তি পরিক্ষা, নিয়োগ পরিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার মাধ্যমে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নাটোরের নারদ নদ সংস্কারসহ নাটোরকে পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে তিনি নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।
একজন জেলা প্রশাসক যখন একটি সংযত, বাঁধা-ধরা জীবনযাপন করেন তখন শাহিনা খাতুন সাধারণ মানুষের সাথে মিশে তাদের আপনজন হয়ে যান। নানা কর্মকান্ডের মাধ্যমে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে হয়ে যান নাটোরের স্বপ্নদ্রষ্টা।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।