
নাজমুল হাসান, নাটোর: এবার ঈদে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর নাটোর। এখানকার ইতিহাস খ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাজি তথা উত্তরা গণভবন এবং বঙ্গজলে অবস্থিত রাণী ভবানী রাজবাড়ির সৌন্দর্য আপনার ঈদ আনন্দকে বাড়িয়ে দেবে কয়েকগুণ। প্রথমেই উত্তরা গণভবন নিয়ে আলোকপাত করা হলো। নাটোরের মাদ্রাসা মোড় থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির অবস্থান। মাদ্রাসা মোড় থেকে আটোরিকসায় জনপ্রতি ভাড়া গুনতে হবে আট টাকা।
দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি
ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে নাটোরের এই দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে ‘উত্তরা গণভবন’ হিসাবে ঘোষনা করেন। এরপর থেকেই নিরাপত্তাজনিত কারণে গণভবণে জনসাধারনের প্রবেশ নিষেধ ছিল। স্থানীয় জনগনের দাবির প্রেক্ষিতে মন্ত্রী পরিষদ সচিবালয়ের সিন্ধান্ত মোতাবেক ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর গণভবন জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এরপর থেকেই দূর-দূরান্তের মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে রাজবাড়ির আঙ্গিনা।
দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দয়ারাম রায়। দয়ারাম ছিলেন নাটোরের রানী ভবানীর অধীনস্থ নায়েব। রানীভবানী দয়ারামকে এতো বিশ্বাস করতেন যে রানীর পক্ষে দয়ারাম গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধান্ত গ্রহণ ও স্বাক্ষর করতেন। রানী দয়ারামের বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দিঘাপতিয়া পরগনার জমিদারী উপহার দেন। ১৭৩৪ সালে প্রায় ৪২ একর জমির উপর দয়ারাম রায় স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন এই দিঘাপতিয়া রাজপ্রসাদটি নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে প্রসাদটি প্রায় ধ্বংশ হয়ে গেলে রাজবাড়িটি পুনঃনির্মাণ করা হয়। দিঘাপতিয়া রাজবংশের রাজাগণ ১৭১০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে ‘উত্তরা গণভবন’ হিসাবে ঘোষনা করেন। এরপর বেশ কয়েকবার মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এখানে ।
দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয় সব বয়সী মানুষ। এর দৃষ্টিনন্দন মূল ফটকের উপরে রয়েছে ইটালির ফোরেন্স থেকে আনা বিশাল ঘড়ি, যা এখনো সঠিক সময় দিচ্ছে এবং এর ঘন্টাধ্বনি বহুদূর থেকে শোনা যায়। প্রতি বুধবার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তি চাবি ঘোরান। এমনিভাবেই চলছে বছরের পর বছর। চারিদিকে সুউচ্চ প্রচীর ও সুগভীর পরিখা পরিবেষ্টিত রাজবাড়ির ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধান প্রাসাদ ভবন, কুমার প্যালেস, কাচারি ভবন, তিনটি কর্তারানী বাড়ি, রান্নাঘর, মোটর গ্যারেজ সহ বিভিন্ন স্থাপনা। প্যালেসের দক্ষিণ রয়েছে ইতালিয়ান গার্ডেন যাতে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন মূল্যবান মার্বেল পাথরে কারুকাজ করা ভাস্কর্য। দেশী-বিদেশী নানা জাতের শোভা বর্ধনকারি গাছ। ভাস্কর্যগুলো একটা পাথরখন্ড কেটে তৈরী। অত্যন্ত নিপুন হাতের কারুকাজ। মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে যায়। প্রধান ভবনের সামনে ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশদের নির্মিত দুটি কামানসহ রাজবাড়িতে মোট ছয়টি কামান রয়েছে। মূল রাজপ্রসাদে প্রবেশের পথে সিঁড়ির দুইপাশে দুটি কালো কৃষ্ণ মূর্তি ছিল। দর্শনার্থীর অসতর্কতায় একটি ভেঙ্গে যাবার পর অপরটি বর্তমানে সংগ্রহ শালায় সংরক্ষণ করা হয়।
নিরাপত্তা ব্যাবস্থা জোরদার সহ গণভবণের বিভিন্ন স্থানে গোপন ক্যামেরা স্থাপন করে ২০১২ সালে ২৫ অক্টোবর জনপ্রতি ১০ টাকা প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ০৫টা পর্যন্ত গণভবন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। পরে প্রবেশ মূল্য বাড়িয়ে জনপ্রতি ২০ টাকা করা হয়। তবে ইতালিয়ান গার্টেন এবং ভবনের ভেতরের অংশ দেখতে আগেভাগেই জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। টিকিট চালুর পর থেকেই দর্শনার্থীদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে উত্তরা গণভবনের আঙ্গিনা। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শনার্থীরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে অবলোকন করে যান গণভবনের অপার সৌন্দর্য।
সম্প্রতি গণভবনকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়। তাতে পাল্টে যায় উত্তরা গণভবন। গণভবনের অভ্যন্তরে গ্র্যান্ড মাদারস হাউজ দখলমুক্ত করা সহ ৮০ভাগ স্থান দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্তকরণ, বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে লাগানো হৈমন্তি গাছ রক্ষা, কবি ইন্দুপ্রভা দেবীর চিঠি ও কবিতাসহ রাজরাজাদের আমলের দ্রব্য দিয়ে সংগ্রহশালা তৈরী করা হয়েছে। সংগ্রহশালায় প্রবেশ ফি জনপ্রতি ৩০ টাকা। এছাড়া মিনি চিড়িয়াখানা, বৃক্ষরোপন, পাখির অভয়াশ্রমসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া মূল ফটকের সামনের জায়গার জন্য যে নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে দর্শনার্থীদের থাকার জন্য হোটেল, সিনেপে¬ক্স, ব্যান্ডিং শপিংমল, লেক, বাচ্চাদের জন্য খেলার মাঠসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নাটোর হবে দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী।
রাণী ভবানী রাজবাড়ি
নাটোর রাজবাড়ী নাটোরসহ সারা বাংলাদেশের গৌরব। এই রাজবাড়ীতেই বসেই এক সময় শাসন করা হতো অর্ধ বাংলা। নাটোর রাজবংশের উজ্জ্বলতম চরিত্র অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভাবানীর রাজবাড়িতে অবসর সময় কাটাতে আসেন স্থানীয় এবং দূর দূরান্তের অনেক ভ্রমনপিয়াসু মানুষ। যান্ত্রিক নগরীর কোলাহল থেকে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলতেই এখানে আসেন অনেকেই। শহর থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত রানী ভবানীর রাজবাড়ি। ঈদে আপনার নির্জনতার স্বাক্ষী হতে পারে এই রাজবাড়ি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭০৬-১৭১০ সালের মধ্যে পঞ্চাশ একর জমির উপর গড়ে উঠে অর্ধ বঙ্গেশ্বরী খ্যাত নাটোরের রানী ভবানীর রাজবাড়ি। রাজবাড়ির চারিদিকে পরিখা দিয়ে ঘেরা, মূল রাজপ্রাসাদ দুটি ছাড়াও রয়েছে ছোট বড় অনেক ভবন, রয়েছে ৫টি পুকুর, মন্দির, মৃত্যুকুপসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
কামদেবের পুত্র রামজীবন এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর সময়ই মূলত রানী ভবানীর অর্ধ বঙ্গেশ্বরী খ্যাতি লাভ এবং রাজবাড়ির প্রসার ঘটে। অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভবানী রাজ্যের শাসনভার নিজ হাতে তুলে নেয়ার পর থেকেই সফলভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। দেশবাসীর কাছে এমনকি বিদেশী ইংরেজদের কাছেও রানী ভবানী ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্রী।
জানা যায়, পলাশির যুদ্ধে রানী ভবানী সিরাজ-উদ-দৌলার পক্ষে সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন। কথিত আছে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা রানী ভবানীর মেয়ে তারাসুন্দরী কে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন।
রানী ভবানীর গর্ভে দু’টি পুত্র সন্তান ও একটি কন্যা সন্তান জন্মে। কিন্তু পুত্র দু’টির অকাল মৃত্যু হলে ১৭৫১ সালে রানীভবানী রামকৃষ্ণ কে দত্তকপুত্র হিসাবে গ্রহন করেন। ১৮০২ সালের পর রামকৃষ্ণ ও রানীভবানীর মৃত্যুর পর রাজবাড়ি দু’অংশে ভাগ হয়ে যায়। রানী ভবানীর দ্ত্তকপুত্র রামকৃষ্ণর দু’পুত্র বিশ্বনাথ পিতার ক্ষুদ্র জমিদারির মালিক হন এবং শিবনাথ লাভ করেন দেবোত্তর সম্পত্তি। এ সময় থেকেই নাটোর রাজবংশ বড় তরফ ও ছোট তরফ নামে পরিচিত হয়।
ইতিহাসের নীরব সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাজবাড়িতে নেই রাজা। নেই অর্ধ বঙ্গেশ্বরী, যাকে নাটোরের মানুষজন এখনো বঙ্গমাতা বলে শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করে। তবে আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের জৌলুস। যা দেখতে প্রতিদিনই আসেন অনেকেই। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে যান ছায়াঘেরা বিভিন্ন গাছপালা শোভিত ও কারুকার্য খচিত ভবন, পুকুর, দৃষ্টিনন্দন মন্দির সহ বিভিন্ন স্থাপনা।
১৯৮৫ সালে এটার একাংকে যুবপার্ক হিসাবে ঘোষনা দেওয়া হয়। সম্প্রতি রাজবাড়িতে শিশুপার্ক ও পিকনিক স্পট, আনন্দ ভবনসহ স্থাপন করা হয়েছে অনেক দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। নাটোরকে পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য রাজবাড়ি সংস্কারে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন জানান, নাটোরকে পর্যটন নগরী হিসাবে সেই সাথে ‘দ্য সিটি অফ কুইন’ হিসাবে পরিচিত করে তুলতে নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ঈদে নিবিগ্নে যাতে দর্শনার্থীরা রাণী ভবানী রাজবাড়ি ও উত্তরা গণভবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সেই জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। টুরিস্ট পুলিশসহ সবাইকে দর্শনার্থীদের দিকে খেয়াল রাখতে সংশ্লিষ্ঠদের বিশেষভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।