নাটোরে যত্রতত্র চলছে পুকুর খনন

নাজমুল হাসান, নাটোর: নাটোরে মহামারি আকার ধারণ করেছে পুকুর খনন। জেলার সাতটি উপজেলায় পুকুর খননের হিড়িক পড়লেও কিছুতেই দমানো যাচ্ছে না। আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন করায় কমে যাচ্ছে আবাদী জমি। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পাশাপশি চাষাবাদের হচ্ছে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে, রাস্তার উপরদিয়ে মাটি বহনের ফলে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে প্রায়ই সড়ক দূর্ঘটনা ঘটছে।
জানা জায়, উত্তরাঞ্চলের শস্য ভান্ডারখ্যাত নাটোর জেলায় মাছ চাষ লাভ জনক হওয়ায় জেলার ৭টি উপজেলাতেই পড়েছে পুকুর কাটার হিড়িক। এতে ফসলি জমি কমে যাওয়ার পাশাপাশি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া রাস্তার উপর দিয়ে মাটি বহনের ফলে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। অপরদিকে, অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার না পাওয়ায় বিক্ষুদ্ধ জনতা পুড়িয়ে দিয়েছে মাটি খননের কাজে ব্যবহৃত এস্কোভেটরি মেশিন। তারপরেও স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়না। অথচ আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে জমির শ্রেণি পরিবর্তন সহ ফসলি জমিতে পুকুর খনন করতে হলে স্থানীয় প্রশাসসনের অনুমোদন লাগবে। কৃষি বিভাগের হিসেব মতে, বিগত ৪ চার বছরে জেলায় আবাদি জমি কমেছে ৬,৪৮৭ হেক্টরে। তিন ফসলি ও চার ফসলি এসব আবাদি জমি এমন আশংকাজনক হারে কমে যাওয়ার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাটোরের জেলা প্রশাসন এবং কৃষি বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলছে থাকলে খাদ্যউদ্বৃত নাটোর জেলায় অচিরেই খাদ্যের সংকট দেখা দেবে। তবে কি পরিমান পুকুর বাড়ছে সেই হিসেব নেই কৃষি বিভাগ বা মৎস বিভাগের কাছে।
গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের দুর্গাপুর-বাবলাতলা গ্রামের কৃষক হারু প্রামাণিক, সাহাদ, শামীম ও শীতলের প্রায় ১০ বিঘা জমি স্বল্প মূল্যে লিজ নিয়েছেন একই গ্রামের বাসিন্দা বদর আলী। হাঁড়িভাঙ্গা বিলের লিজ নেয়া সেই জমিতেই শুরু করেন পুকুর খনন। পাশের ৯ বিঘা জমিতে আরেকটি পুকুর খনন চলছে। হাঁড়িভাঙ্গা বিলে জমি আছে এমন অন্তত ১৫ জন কৃষক বলেন, বিল এলাকায় কমপক্ষে ২০টি পুকুর খনন করা হয়েছে। আরও ১০টি পুকুর খননের কাজ চলছে। এর মধ্যে ফিরোজ হোসেন তালুকদারের ১৪ বিঘা ও ছয় বিঘা আয়তনের দুটি, নজরুল ইসলামের ১২ বিঘা, ফজলুর রহমানের ১২ বিঘা, মিজানুর রহমান তালুকদারের ১০ বিঘা জমির পুরোটা পুকুর করা হচ্ছে। অন্য প্রভাবশালী জমির মালিকেরাও পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন। বিলে পুকুর খনন বন্ধের দাবিতে স্থানীয় জমির শতাধিক মালিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তেমন কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ফলে উত্তেজিত জনতা গত ২৩ মার্চ রাতে মাটি কাটার জন্য ব্যবহৃত দুটি এক্সেকেভেটর মেশিন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। এরপরেও গুরুদাসপুরে থেমে নেই মাটি কেটে পুকুর খনন। বিয়াঘাট ইউনিয়ন ছাড়াও চাপিলা, ধারাবারিয়া ইউনিয়নে চলছে পুকুর কাটা।
এ বিষয়ে গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনির হোসেন বলেন, কৃষিজমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই। কেউ পুকুর করতে চাইলে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যেতে পারে। কিন্তু হাঁড়িভাঙ্গা বিলে পুকুর খননকারীরা সেই নিয়ম অনুসরণ করেননি। তিনি কৃষকদের লিখিত অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এর সত্যতা পেয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি পুকুর খনন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। কৃষিজমিতে পুকুর খনন বন্ধে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে।
এছাড়া সিংড়া উপজেলার সোনাপুর, পমগ্রাম, পুঠিমারী, কুশাবাড়ী, নীলচরা, পাটকান্দি, খাগোরবাড়িয়া, মটগ্রাম, ধুলিয়াডাঙ্গা, লারুয়া, বড়সাঔল, নলবাতা, দিঘোলগ্রাম, আরকান্দি, চৌগ্রাম সহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুওে সর্বত্রই তিন ফসলি ও দো ফসলি জমিতে পুকুর কাটতে দেখা গেছে। এসব পুকুর কাটার সাথে জড়িক রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। ক্রমাগত পুকুর কেটে মাটি বহনের ফলে আকস্মিক বৃষ্টিতে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কে জমে থাকা মাটি পিচ্ছিল হয়ে হাজারো যাত্রীকে প্রায়ই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর এই ঘটনার সাথে পুকুর খননকারী ও ইটভাটা মালিকদের দায়ী করছে স্থানীয় প্রশাসন।
অপরদিকে, লালপুর উপজেলার ওয়ালিয়া, বিলমাড়িয়া, দুড়দুড়িয়া, লালপুর, দুয়ারিয়া, কদিমচিলান ইউনিয়নে চলছে পুকুর কাটা। এসব পুকুর কাটার ক্ষেত্রে প্রশাসনের কোন অনুমতি নেই । এ বিষয়ে লালপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুল ইসলাম বলেন, এভাবে পুকুর খনন চলতে থাকলে লালপুরে আবাদি জমি একেবারে কমে যাবে। এতে পরিবেশের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটবে। আমরা সবসময় কৃষকদের অনাবাদি জমিতে পুকুর খননের পরামর্শ দেই। কিন্তু কিছু অসাধু কৃষক বেশি লাভের আশায় আবাদি জমিতে পুকুর খনন করেন। লালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নজরুল ইসলাম বলেন, আবাদি জমিতে পুকুর খনন কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে আবাদি জমিতে পুকুর খনন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বড়াইগ্রাম উপজেলাতেও চলছে অনুমোদনহীন পুকুর খনন। চান্দাই ইউনিয়ন সদরের এহিয়া ও বাকী অনুমোদন না নিয়েই পুকুর খনন করছেন। উপজেলার চেচুয়ার বিলে ধারাবারিষা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক রিপন সরকার চেচুয়ার বিলে দ্বারিকুশী মৌজায় সরকারী ১০ বিঘা খাস জমি সহ ৪৮ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছেন। বিলের মাঝ বরাবর উচু করে পুকুর খনন করার ফলে জলাবদ্ধতা তৈরির আশংকা করছেন এলাকাবাসী । এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার পাচ্ছেন না এলাকাবাসী ।
এ ছাড়া নাটোর সদর উপজেলার আগদিঘা, মাঝদিঘা, মির্জাপুর দিঘা শংকরভাগ ,পিপরুল ,বাশভাগ, সেনভাগ , শ্যামনগর লক্ষীকোল সহ বিভিন্ন স্থানে চলছে পুকুর খনন। শংকরভাগ বাজারের দক্ষিণে মাউত বিলে অনেকগুলো পুকুর কাটার ফলে বিলের পানি নিস্কাশন বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার আশংকা করছেন এলাকাবাসী ।
নাটোরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, নাটোরের মত উর্বর এবং তিন থেকে চার ফসলি এমন জমি দেশের খুব কম যায়গাতেই আছে। সে কারণে নাটোর জেলা শস্য ভান্ডার হিসাবে খ্যাত। নাটোরে প্রচুর পরিমান মুগ ডাল, রসুন, ধান, গম, আখসহ বিচিত্র রকমের ফসল হয়। এই জেলার পেয়ারা আম এবং ড্রাগন সারাদেশে খুবই সমাদৃত। কিন্তু যেভাবে আবাদি জমি কমছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তা ধরে রাখা সম্ভব হবেনা। ইটভাটা মালিকদের প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা আবাদি জমিতে পুকুর কেটে ভাটাতে মাটি বিক্রি করছেন বলেও জানান তিনি। তবে সাময়িক লাভ হলেও ভবিষ্যতের জন্য বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। সেসব জমি পুকুর কাটা হচ্ছে তা পুনরায় আবাদি জমিতে ফিরে আসা সম্ভব হবেনা।
নাটোর জেলাতে ২০১৩-১৪ মৌসুমে নাটোরে আবাদি জমির পরিমান ছিল ১,৫৩,৬৭৪ হেক্টর, ২০১৪-১৫ ১,৫০,৮৩৮ হেক্টর, ২০১৫-১৬ মৌসুমে ১,৪৮,৭৪৩ চলতি মৌসুম ২০১৬-১৭ তা কমে দাড়িয়েছে ১,৪৭,১৮৭ হেক্টর জমিতে।
জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষক সেলিম রেজা বলেন, যেভাবে পুকুর বাড়ছে ঠিক একইভাবে মাছের দাম কমছে। অদূর ভবিষ্যতে মাছ খাওয়ার লোক থাকবেনা। তাছাড়া যেভাবে বিভিন্ন খাদ্য খাইয়ে মাছকে দ্রুত বড় করা হচ্ছে তাতে মানবদেহর জন্য হুমকি হয়ে দাড়াবে এসব বিষাক্ত মাছ।
মাছচাষী সাকেদুল ইসলাম টিপু বলেন, নাটোরে পুকুরের সংখ্যা বেড়ে গেছে দ্বিগুনের বেশি। সেকারনে মাছের উৎপাদন বেড়ে গেছে তবে চাহিদা বাড়েনি। তাই কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষীরা। তিনি বলেন, ঢাকার ফুলবাড়ি আড়তে ২-৪ কেজি ওজনের রুই বিক্রি করেছন ১৮০-২২০ টাকা দরে। নাটোর থেকে ১৫ মণ মাছ ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করেছেন ১ লাখ ২ হাজার টাকায়। গত বছর একই সাইজের সমপরিমান মাছ বিক্রি করেছেন ৩ লাখ টাকায়।
নাটোর সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মেহেদুল ইসলাম বলেন, যেভাবে পুকুর কাটা হচ্ছে তা যদি সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতায় বন্ধ করা না যায় তবে তা ভয়ঙ্কর রূপ নিবে। আবাদি জমিতে পুকুর খনন কঠোর ভাবে বন্ধ করতে প্রশাসসের পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানা তিনি। তিনি বলেন কোন জমি ফসল উৎপাদনের উপযোগী হতে প্রায় আড়াই লক্ষ বছর সময় লাগে। সেকারনে অবহেলা করে আবাদি জমি কাউকে নষ্ট করতে দেয়া উচিত না।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, মানুষ কেন বুঝতে চাচ্ছেনা যে আবাদি জমি কমে গেলে তাদের জীবন সংকাটপ্ন হবে। আবাদি জমি রক্ষা করার ব্যাপারে মন্ত্রনালয়ের সাথে কথা বলেছেন বলে জানান তিনি। শাহিনা খাতুন আরো বলেন, ফসলি জমিতে পুকুর খনন বা শিল্পায়ন কঠোর হাতে দমন করা হবে।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।