হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ খেলাধূলা : বাড়ছে ইন্টারনেটসহ মাদকের আসক্তি

বিশেষ প্রতিনিধি : এক সময় গ্রামের বিকেলটা ছিল শুধুমাত্র খেলাধূলার জন্য বরাদ্দ। হা-ডু-ডু, কানামাছি,বৌউচি,এক্কাদোক্কা,কুতকুত, গোল্লাচুট, দাড়িয়াবান্দা,পুতুল খেলা, ফুটবলসহ নানান ধরণের গ্রামীণ খেলা বিলুপ্ত প্রায়। পাড়া মহল্লা কিংবা কয়েক গ্রাম মিলে প্রতিদিন খেলার আয়োজন হত। এখন আর এসব খেলাধূলা চোখে পড়ে না। খেলা ধুলার বদলে আজ গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে যাচ্ছে মাদক। বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। কমছে পরিবারে পরিবারে, মানুষে মানুষে সম্প্রতি, বদলে যাচ্ছে সমাজ চিত্র।
শহরে কিংবা গ্রামে বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্টানেও নেই খেলার মাঠ। নেই খেলাধূলার পরিবেশ। খেলা ধূলা কমে যাওয়ার ফলে গ্রামাঞ্চল আর শহরের ছেলে-মেয়েরা সবাই আসক্ত হচ্ছে ফেইসবুক কিংবা ইন্টারনেটের অধিক ব্যবহারের দিকে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের যথার্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গ্রামীণ খেলাধূলার বিলুপ্তির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নেত্রকোণার এআরএফবি’র চেয়ারম্যান দিলওয়ার খান বলেন, খেলাধুলার না করার কারণে শিশুরা মানসিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সমাজে অপরাধ বাড়ছে। কোথাও আর আগের মতো খেলার ধূলার চর্চা হচ্ছে না।
সিনিয়র সাংবাদিক পিনাকী তালুকদার বলেন, সুস্থ দেহ সুস্থ মন, একসময় খেলাধূলার জন্য স্কুল গুলো বিরতি দেয়া হতো। খেলা ধূলা কমে যাওয়ার কারণে সামাজিক সর্ম্পক ছিন্ন হচ্ছে। শিশুদের মানসিক বিকাশে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। সামাজিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে। একসময় খেলার ধূলায় জিতলে সিল দেয়া হতো। এই উৎসাহতে একজন মানুষের মাঝে যে মনোবল তৈরী হয় তা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এখন আর এসব নেই।
নেত্রকোণা প্রকৃতি ও পরিবেশ বাঁচা আন্দোলনের সভাপতি কবি তানভীর জাহান চৌধুরী বলেন,আমরা শৈশবে যে খেলাধূলা করতাম তা এখন নেই। এখন ছোট ছোট শিশুরাও মাদকে আসক্ত হচ্ছে। খেলাধূলা কমে যাওয়ার কারণে স্কুল কলেজ এমনকি গ্রাম পর্যায়ে মাদকের ছোবল দিচ্ছে। আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই রাষ্ট্রিয় পর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক পর্যায়েও খেলাধূলার আয়োজন বাড়াতে হবে।
ময়ময়নসিংহ মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপক সরকার জানান, গ্রাম পর্যায়ে কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ে খেলাধূলার প্রতিযোগিতা করা যেতে পারে। ইউনিয়ন পর্যায়ে তেরোটি স্ট্যান্ডিং কমিটির একটি হচ্ছে শিশুদের খেলাধূলার মনিটরিং করার রয়েছে। খেলাধূলার পরিবেশ রক্ষা, মাঠ গুলোর যতœ নেয়া,রক্ষা করা। সরকারের পাশাপাশি সচেতনদের এগিয়ে আসতে হবে। মা-বাবার এগিয়ে আসতে হবে। কারণ শিশু মানসিক বিকাশ ঘটাতে না পারলে ভবিষ্যৎ সম্বাবনা কমে যাবে।
নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল্লাহ ইমরান জানান, আমাদের শৈশবে যে সময় টুকু খেলেছি। আমাদের নতুন প্রজন্মরা এখন এই সময়টুকু খেলাধূলা করতে পারছে না। তারা বইয়ের পাতায় সময়টুকু দিতে হচ্ছে। সুস্থ সুন্দর মানুষ হতে হলে খেলাধূলার বিকাশ ঘটাতে হবে। নয়তো নতুন প্রজন্মকে আমরা মানসিক দুর্বল করে রেখে যাবো। সুতরাং সুন্দর সমাজ বির্নিমাণে পাঠের পাশাপাশি অবশ্যই খেলাধূলার চর্চা বাড়াতে হবে।
নেত্রকোণা জেলা সূজন এর সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক শ্যামলেন্দু পাল বলেন হা-ডু-ডু, বৌচি, গোল্লাচুট, দারিয়াবান্দা খেলা আজ বিলুপ্ত। শৈশবে যেসব খেলা খেলেছি এখন আর তা নেই। খেলা ধূলা শারীরিক ও মানসিক বিকালে সহায়তা করে। সামাজিক ভাতৃত্ববোধ তৈরী করে।ফুটবল খেলতে হলে বাইশ জন খেলোয়াড় লাগে, এই বাইশজন মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা, সামাজিকতা এবং শারীরিক যে চর্চা হয় এটা আর কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। খেলাধূলার মাধ্যমে শিশুর যে টুকু বিকাশ হয় তা কিভাবে পূরণ করা সম্ভব ?
একসময়ের কৃতি ফুটবলার বীরমুক্তিযোদ্ধা জেলা প্রেসক্লাবের সহসভাপতি হায়দার জাহান চৌধুরী বলেন, কিন্ডার গার্টেনে মাধ্যমে আজকের শিশুদের উপর অতিরিক্ত বই চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে শিশুদের বন্দি করে রাখা হচ্ছে। এসব কারণে গ্রামীণ খেলাধূলা বিলুপ্ত হচ্ছে। এজন্য শারীরিক ফিটনেস হারাচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। অল্প বয়সে এসব শিশু নানান রোগে আক্রান্ত হবে। খেলা ধুলায় যে সামাজিকতার সৃষ্টি হতো,এখন তা নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে স্কুল কলেজ গুলোতে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধূলা বাড়াতে হবে। সব স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষককে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধুমাত্র পড়াশুনায় মানুষের আত্ববিকাশ ঘটবে না বলেও জানান তিনি।
নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম ফখরুল ইসলাম ফিরোজ জানান, গ্রামাঞ্চলেও মাদক পৌঁছে গেছে। সীমান্তের ছেলে মেয়েদের মাঝে মাদকের আসক্তি দেখে সম্প্রতি আমি মাসব্যাপি ফুটবল খেলার আয়োজন করেছি।খেলায় হাজার হাজার মানুষের অংশ গ্রহণ দেখেছি। মানুষ এখনো গ্রামীণ এসব খেলাধূলা চায়। খেলাধূলা বাড়ালে মানুষে মানুষে সম্প্রতি বাড়বে। সমাজের অপরাধ কমবে। এজন্য সরকারের উদ্যোগ নিচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।