কলমাকান্দায় সীমান্তে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট

হাবিব সরোয়ার আজাদ: পাহাড়ি ছড়ার ময়লা যুক্ত গোলা পানি না হয় টিলার নিচে তিন চাঁকর (চাঁক্কি) তৈরী অগভীর কুঁপে(কুয়ো বা ইন্দরা)’র ময়লা পানিই শতাধিক আদিবাসী পরিবারের নিকট একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে এমন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার টিলাঘেরা পাঁচ পাড়ার শতাধিক আদিবাসী পরিবারের লোকজন স্বাধীনতা পরবর্তী গত ৪৭ বছর ধরেই।’
সম্প্রতি সরজমিনে গেলে বিশুদ্ধ পানির অভাবে আদিবাসী পল্লীর দুর্ভোগের শিকার পরিবারের লোকজন জানান, উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী চেংগ্নী গ্রামের হতদরিদ্র পাঁচ পাড়ায় লোকজনের জন্য সরকারি ভাবে টিউবওয়েল কিংবা গভীর কুয়ো তৈরী করে না দেয়ায় তাদের ভাগ্যে জুটছে না বিশুদ্ধ পানি।’ গ্রামে স্বচ্চল পরিবারের লোকজনের সুবিধামত নিজ নিজ বাড়িতে কয়েকটি টিওবওয়েল থাকলেও দিন আনেন দিন খেয়ে পড়ে আছেন এমন হতদরিদ্র সুবিধা বঞ্চিত আদিবাসী লোকজনের ব্যক্তিগত সামর্থ না থাকায় তারা নিজেদের একটি পাড়াতেও বসাতে পারছেন না বিশুদ্ধ পানির জন্য টিওবওয়েল কিংবা একটি গভীর কুঁয়ো।’
উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের টিলাঘেরা চেংগ্নীর টেংরা টিলাপাড়া, বাঙ চাকুয়া, বাতানগ্রী, কনকোণা, ধলধলা সহ পাঁচ পাড়ার লোকজন তাদের পানি দুভোর্গের কথা জানাতে গেলে বললেন, এক সময় পাড়ার লোকজন ওপারের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা চেংগ্নী ছড়ার ময়লাযুক্ত পানিই কাপড় দিয়ে ছেঁকে কোন রকম পরিস্কার করে পান করতেন।’ ধীরে ধীরে স্বচ্চল পরিবারের লোকজন সুবিধা থাকায় গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে টিওবওয়েল বসিয়েছেন কিন্তু সেগুলোতেও রয়েছে আয়রণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত।’ অপরদিকে আর্থীক সুবিধা না থাকায় পাড়ার লোকজন নিজেরা হাজার দু’হাজার হাজার টাকা সংগ্রহ করে বনবিভাগের টিলার নিচে তিনটি পাঁকা চাঁকায় প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর পুর্বে কোন রকম একটি কুঁয়ো (ইন্দরা) বসিয়ে খাবার পানি সহ পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজনে পানি সংগ্রহ করে যাচ্ছেন।’
উপজেলার চেংগ্নী’র বাতানগ্রী পাড়ার ফাতেমা সাংমা (৬৫) জানান, এই তিন চাঁকার কুয়োতে বছরের কার্তিক মাস থেকে চৈত্র মাস পর্য়্যন্ত ৬ মাস পানিই থাকেনা, শুঁকিয়ে যায়, কারন কূয়াটি গভীর নয়, এ কারনে বছরের বাকি ছ’মাস চেংগ্নী ছড়ার পানি সংগ্রহ করতে হয় তাও এক সময় ছড়ার পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফকে বলে কয়ে ছড়ার উৎস মুখ জিরো লাইন থেকেও পানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে হয়।’ একই গ্রামের টেংরা টিলাপাড়ার প্রয়াত জিনেং রিছিলের স্ত্রী শতবর্ষী জেমদিনী রাকসাম অনেকটা ক্ষোভ নিয়ে নিজেদের গারো (মান্দি) ভাষায় টিলার ওপর বসেই সম্প্রতি বলছিলেন “সতব্রিশনী বিলছি নাম্মাচিক রিংমানজাজক’’ (অর্থাৎ) ৪৭ বছরেও বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারলাম না)।’ চেংগ্নী মাতৃমন্ডলীর পাষ্টার গিজিয়ন চিসিম (৬৫) বললেন, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে শুরু করে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার সহ অনেকের কাছে ধর্ণা দিয়েও এ এলাকার লোকজনের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে একটি টিওবয়েল কিংবা একটি গভীর কুঁয়োর ব্যবস্থা আজো করা গেলনা।
উপজেলার চেংগ্নী টেংরা টিলাপাড়ার সুবিনাথ সাংমা (৫৫) বলেন, একটি তিন চাঁকার কুয়ো থেকে পানি সংগ্রহ করছে পাঁচ পাড়ার আবাল বৃদ্ধ বণিতাকে লাইন ধরতে হয়, আবার কুয়োয় পানি না থাকলে সেই সীমান্তের জিরো লাইন থেকে তৈলের টিন, কলসী না হয় বালতি জোড়ায় পানি ভড়ে ঘাড়ে বয়ে আনতে হয়।’ তিনি আরো বলেন , কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি উদ্যোগী হয়ে একটি টিওবয়েল বা গভীর কুঁয়ো বসিয়ে দিতেন এ পাচঁ পাড়ার লোকজনের বিশুদ্ধ পানির দুর্ভোগ দূর হয়ে যেত।’
উপজেলার কলমাকান্দার ৫নং লেঙ্গুরা ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান ভুঁইয়ার নিকট বুধবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে চেংগ্নীর ওই এলাকায় পানির দুর্ভোগের বিষয়টি পরিষদ অবহিত আছেন স্বীকার করে বলেন, আসলে ওখানে প্রায় হাজার ফুট গভীর নলকুপ বসাতে হবে, যা অত্যন্ত ব্যায় বহুল, মাটির নীচ থেকে পাথর সড়িয়ে যদিও বিকল্প হিসাবে একটি গভীর কুঁয়ো বসানো যায় তাতেও ৭০ থেকে লাখ টাকা ব্যায় হবে।’ তিনি আরো বলেন, সরাসরি উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলেই কেবল দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই এলাকায় পানির সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে।’
নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুজ্জামানের নিকট এ বিষয়ে স্ববিস্তারে জানিয়ে বুধবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওই এলাকার আদিবাসী পরিবারের লোকজনের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই এটা আমি আগে জানতাম না, এখন খোঁজ খবর নিয়ে সেই এলাকায় সরকারি ভাবে টিওবওয়েল কিংবা একটি গভীর কুঁয়ো তৈরীর জন্য উপজেলাা প্রশাসন থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।