ফসলের মাঠ থেকে শিল্পের দোয়ারে নারীদের জয়যাত্রা

বিশেষ প্রতিনিধি: ফসলের মাঠ থেকে শিল্পের দোয়ার, কোথায় নেই আজ নারীদের পদচারণা। ঘর দোর কিংবা অফিস আদালত, সমানভাবে সামলে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে একসময়ের অবহেলিত নারীরা। সরকারী দফতরের কর্মরত নারীরা নারী শিক্ষা, বাল্য বিবাহসহ নারী উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকেই শূন্য থেকে শুরু করে স্বাক্ষর রাখছেন সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে। শুধু তাই নয়, নিজে প্রতিষ্টিত হয়ে স্বাবলম্বি করছেন আশপাশের নারীদেরকেও।
বেগম রোকেয়া। না পায়রাবন্দের রোকেয়া নয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহের রোকেয়া, সবার পরিচিত মাস্তুরা আপা। মাত্র সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রী অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়। এরপর সংসার জীবন ছিল মাত্র সাত বছর। সাত বছরে তিনি দুই কন্যার জননী হন। মানবাধিকার কর্মী ও সমাজ সংগঠক, নেত্রকোনার স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির নির্বাহী পরিচালক, জাহানারা স্মৃতি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নেত্রকোনা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারিও তিনি।
তাঁর বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর পরিবার নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে পরেন তিনি। অভাব অনটনের মধ্যে থেকে নিজেকে টেনে বের করেছেন মুক্তো আলোয়। জীবনে পদে পদে লড়াই করে এগিয়ে চলেছেন জীবনের পথে। নিজেকে অন্ধকার থেকে বের করে চলছেন উন্নয়নের পথে। কাজ করছেন নারীর অধিকার নিয়ে। নিজের অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছেন সমাজ সংসারকে। শুধু তাই নয়,বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্টিত স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতিতে কাজ করছেন সহস্্রাধিক নারী পুরুষ।
তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নেত্রকোনা সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। চাকুরী থেকে অগ্রিম অবসর নিয়ে তিনি নেত্রকোনার স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এনজিও কমের্র জন্য ঘরের কোণা ছেড়ে পৃথিবীর অনেক দেশ সফর করেছেন। তাঁর প্রথম বিদেশ সফর ছিল ১৯৮৩ সালে ভারতের কলকাতা ও মাদ্রাজ এবং একই বছর শ্রীলংকার কলম্বো। এনজিও কর্ম কান্ডে এরপর এশিয়া মহাদেশের ভারত (একাধিক বার), নেপাল, শ্রীলংকা , থাইল্যান্ড , চীন ; ইউরুপ মহাদেশের নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক , ফিনল্যা- , বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড , জার্মানি, ইংল্যান্ড , ইটালি , স্পেন ; দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল, পোর্তোরিকো , সাওপোলো ; উত্তর আমেরিকা মহাদেশের যুক্তরাষ্ট্র (টেক্সাস, নিউ ইয়র্ক), কানাডা (টরন্টো, হেলীফেক্স ) এবং আফ্রিকা মহাদেশের কেনিয়ার নাইরুবি ভ্রমন করেছেন। তিনি ২০১০ সালে আফ্রিকা মহাদেশের কেনিয়ার নাইরুবিতে বিশ্ব মাইক্রো ক্রেডিট সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের নারী উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের কামরুন্নাহার লিপি। সংসারের টানাপোড়েনে মাত্র এক যুগ আগে আটশো টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিলেন সেলাইয়ের কাজ। এরপর থেকে আর থেমে থাকেননি লিপি। বর্তমানে নিজ বাড়িতেই তিনি গড়ে তুলেছেন মিনি গার্মেণ্টস। এখন তার গার্মেণ্টেসে কাজ করছেন ১০২ জন শ্রমিক। যার নব্বই ভাগই নারী কর্মী। এসব কর্মরত শ্রমিকরা বাড়িতে থেকে প্রত্যেকে ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে পনেরো হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছেন।
অনন্তপুর গ্রামের নারী নেত্র কারুপণ্যের প্রতিষ্টাতা কামরুন্নাহার লিপি জানান, যেকোনো মানুষের যদি ইচ্ছে শক্তি থাকে তবে কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না। কত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সামনে এগুতে হয়। জীবন চলার পথে বাধা থাকবেই, এসব অতিক্রম করেই মানুষকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

গ্রাম থেকে ওঠে আসার কথা অকপটে স্বীকার করলেন নেত্রকোনা সরকারী মহিলা কলেজের প্রভাষক সাদিয়া আক্তার। জীবনের পদে পদে কঠিন সংগ্রামে পথ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়পশুনা করে বিসিএস করতে পেরেছি। বর্তমান সরকার নারীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়েছে। এ সকল সুবিধা কাজে লাগিয়ে গ্রামের অবহেলিত নারীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানানও তিনি।
শুধু সাদিয়াই নন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকতা হয়ে নারীদের অগ্রযাত্রায় কাজ করছেন অনেক নারীই। পিছিয়ে পরা নারীদের এগিয়ে নিয়ে দেশকে আরো সামনের দিয়ে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় জানান তারাও।
নেত্রকোনা দশ উপজেলার মধ্যে আটপাড়া, বারহাট্টা, পূর্বধলা ও নেত্রকোনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা।
বারহাট্টার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদা ইয়াসমিন জানান, নারীরা কিন্তু এখন তৃণমূল পর্যায় থেকে আকাশ পথ পর্যন্ত সামলাচ্ছে নারীরা। নারীরা কেন পিছিয়ে থাকবে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী,স্পীকার নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রীও নারী। দেশের বড় বড় পদ গুলোতে চ্যালেঞ্জিং কাজেও ভালো করছে নারীরা। তাই সরকারের দেয়া সকল সুবিধাকে কাজে লাগালে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে। দেশের আজকের এই অবস্থান নারীদের এগিয়ে আসার কারণেই হয়েছে।
জানাতে চাইলে নেত্রকোনা সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবিহা সুলতানা জানান, গত এক দশক আগেও নারীরা যে, একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসক হতে পারবেন সেটা অনেকেই চিন্তাই করতে পারেনি। আমি যখন একটি উপজেলায় চাকরী করি, তখন একজন ক্লাস ফোরের বাচ্চা তার মাকে জিজ্ঞেস করেছে যে, মা ইউএনও তো ছেলেরা হয়, মেয়েরা তো ইউএনও হয়না, তখন তার মা বলেছে উনিই ইউএনও। তারপর আমার অফিসে এসে তার মা আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তার মেয়েকে। এখন আমাদের সমাজ মেনে নিয়েছে। আমরা কর্মক্ষেত্রে ভালো করছি। পাশের জেলা কিশোরগঞ্জে আটটি উপজেলাই নারী কর্মকর্তা। নারী কর্মকর্তাদের মানুষ ইতিবাচক হিসেবে মেনে নিয়েছে। সমাজের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে নারীরা ভালো করছে। ভালো করবে।
নেত্রকোনা সদর উপজেলা পরিষদ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান তুহিন আক্তার জানান, রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে চলেছে। দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা পিছিয়ে আছে। তাদের জন্য আরো নানামুখি পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি, সরকারের সকল সুবিধা তাদের কাছে পৌছে দিয়ে তাদের এগিয়ে আসতে সাহায্য করতে হবে।

বংশ পরম্পরায় গারো নারীদের নারী নেতৃত্ব চলে আসায় মাঠে ঘাটে কাজ করছেন তারা। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে চাকুরীতে অগ্রাধিকারের দাবী তুলছেন তারা। নেত্রকোণায় ৬ টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির প্রায় দেড় লক্ষাধিক লোকবাস করে। এর মধ্যে গারো লক্ষাধিক, হাজং প্রায় ১৫ হাজার, কোচ ১০ হাজারের মতো উপজাতি জেলার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা বাস করে। জেলার গারো নারীরা সংসারের পাশাপাশি ক্ষেতে খামারেও কাজ করে সমান ভাবে।
বড়োদের পাশাপাশি স্কুল-কলেজে পড়–য়া গারো মেয়েরাও কাজ করে ক্ষেতে খামারে। এসব গারো শিক্ষার্থীদের দাবী, তাদের সরকারী সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা গ্রামের গারো পরিবারের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী মৗসুমী জানান, কলেজের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে রোজ হিসেবে (দৈনক মুজুরীর ভিত্তিতে) অন্যদের ক্ষেতের ধান রোপন থেকে শুরু করে সব ধরণের শ্রমিকের কাজ করে টাকা রোজগার করে থাকি। এতে পড়াশুনার ও সংসার খরচ চালিয়ে মা-বাবাকে সাহায্য করি। কিন্তু এপযর্ন্ত সরকারী বেসরকারী সাহায্য কিংবা বৃত্তি আমি পাইনি।
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে গারো নারীরা সমাজে বিশেষ অবদান রাখতে পারবে বলে জানান, লেঙ্গুরা এলাকার মালতী সাংমা। এছাড়াও নারী অধিকারের ক্ষেত্রে সংসারের সব কাজ করেও গারো নারীরা অধিকার বঞ্চিত রয়েছে বলে জানান গারো সমাজের নেতৃস্থানীয় নারীরা।
নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ অভিভাবকদের উদ্ধুদ্ধ করে নারীদের এগিয়ে আনার আহ্বান নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা।
জেলা পরিসংখন কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম জানান, নেত্রকোনায় মোট ১১ লক্ষ বাষট্টি হাজার দুইশো চব্বিশ জন নারীর মধ্যে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে কর্মরত আছে বিশ হাজার চারশো সাতান্ন জন নারী। যা শতকরা প্রায় আট ভাগের মতো।
জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফেরদৌসী বেগম জানান, ‘শেখ হাসিনার বার্তা, নারী পুরুষ সমতা’ গ্রামাঞ্চলের প্রত্যেক নারীদের এগিয়ে নিতে নেয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। শিক্ষিত নারীদের চাকুরী ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের কথাও জানান জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা। সংসার, সমাজ কিংবা দেশকে এগিয়ে নিতে হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের আরো কর্মমূখি হতে হবে। সরকার প্রত্যেক নারীকে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। গৃহবধুরাও যাতে ঘরে বসে নূন্যতম এক হাজার টাকা আয় করতে পারে সেই উদ্যোগ সরকার হাতে নিয়েছে। নারীদের জন্য ইলেকট্রোনিক্স কাজের ট্রেনিং, ট্রেইলারিং,হাতের কাজ সহ বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং করানো হচ্ছে। বর্তমানে একটি নিয়োগে চারশো চুরান্নব্বই জনের মধ্যে চার জন ছেলে মেয়ে নেয়া হবে আর বাকি চারশো নব্বই জনই মেয়ে নেয়া হচ্ছে। সুতারাং এই সুযোগকে নারীদের কাজে লাগাতে হবে।
নারীরা এগিয়ে আসলেই দেশ এগুবে, এমন দাবী কর্মক্ষেত্রে সফল নারীদের। তাই পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ নারীদের এগিয়ে নিতে সরকারী আরো নানামূখী পদক্ষেপ চান সচেতন মহল।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।