দুর্গাপুরে রিক্সাচালক শিক্ষানুরাগী তারা মিয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত

হানিফ উল্লাহ আকাশ: নেত্রকোনার দূর্গাপুর উপজেলার লেংগুড়া গ্রামের রিক্সাচালক তারা মিয়া (৩০)। পেশায় কখনো দিন মজুর আবার কখনো তিনচাকার রিক্সাওয়ালা। তার এই আয় দিয়েই চলে নিজের সংসার। সেই সাথে চলে হতাশা ভরা জীবনে নতুন সমাজ বির্নিমানের স্বপ্ন। এই স্বপ্নের স্বাদ কতটুকু পূরণ হবে তারা মিয়ার হাত ধরে, সেই প্রশ্ন এখন অনেকের মনে। নিজে নিরক্ষর তবু যারা আর্থিক অনটনের জন্য শিক্ষা অর্জন করতে বাধাঁপ্রাপ্ত হচ্ছে সেইসব শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ,খাতা,কলম,পেন্সিল সহ বিভিন্ন উপকরণ কিনে বিনামূল্যে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে বিতরণ করেন তাঁরা মিয়া। সমাজের পশ্চাৎপদ পরিবারে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
জানা গেছে,তারা মিয়া ২০১৫ সাল থেকে দূর্গাপুর উপজেলার নলুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,দেবদুল মিশনারী স্কুল, চক-লেঙ্গুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়,বিরিশিরি প্রতিবন্ধি স্কুল ও বিরিশিরি মডেল স্কুল সহ ১৭টি বিদ্যালয়ের কয়েকশত অতিদরিদ্র শিক্ষার্থীকে টিফিনবক্স, খাতা,কলম ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে আসছেন। তারা মিয়ার পারিবারিক জীবনের স্ত্রী ও ১ ছেলে সন্তানসহ মাকে নিয়ে টানাপোড়নের সংসার। তবুও সমাজ বির্নিমানের স্বপ্ন নিয়ে দৈনন্দিন রোজী-রোজগার থেকে একটি অংশ সঞ্চয় করে কিছু টাকা জমা হলেই, স্কুল গুলোতে কার কি প্রয়োজন সে বিষয়ে খোঁজ নিয়েই সাধ্য অনুয়ায়ী সমাধান করার চেষ্টা করেন এই শিক্ষানূরাগী।
বাবা আব্দুল হেলিম মা রহিমা আক্তারের সংসারে ৩ ছেলের মধ্যে তারা মিয়া বড় সন্তান। তিন জনের মধ্যে কেউই পড়াশুনার করতে পারেননি। মেঝু ভাই হানিফ মিয়া পেশায় কৃষক ও ছোট ভাই সরুজ মিয়া লড়ি চালক। বাবা মায়ের টানাপোড়ানের সংসারের শুরু থেকেই বাবা অসচেতন ও উদাসীন ভাবেই জীবন-যাপন করতেন। তাই অনেক আগে মা রহিমাকে ছেড়ে পূনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় বাবা। পড়ে তিন ভাইয়ের মধ্যে কেউ পড়াশুনা করতে পারেনি। ফলে সেই হতাশা থেকেই পড়াশুনার প্রবল আগ্রহ নিয়ে অবহেলিত ও দরিদ্র শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর ব্রুত নিয়ে কাজ করেন দিন মুজুর এই রিক্সাচালক।
তারা মিয়ার স্ত্রীর নাজমা আক্তার বলেন,আমার স্বামীকে আমার কাছে অনেক মহান ব্যক্তি মনে হয়। এ সমাজে অনেকের অনেক সাধ্য আছে কিন্তু এমন সাধ কি কারো হয়, যে নিজের পয়সায় অন্যের সন্তানদের পড়াশুনা করায়। আমি তার এমন কাজে সব সময় সহযোগীতা করি এবং উৎসাহ যোগাই। তারা মিয়ার ছোটভাই সুরুজ মিয়া বলেন, ভাই ছোট কালে পড়াশুনা করতে পারেনি আমাদেরও কারাতে পারেনি তাই তার খুব আক্ষেপ। সেজন্য সমাজের দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের নানা ভাবে সহযোগীতা করেন তিনি। এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। দুর্গাপুর ২নং দেবদুল গারো ব্যপ্টিষ্ট কনভেনশন মিশনারী স্কুলের সভাপতি প্রদীপ মানকিন জানান, তারা মিয়া প্রায়ই স্কুলে এসে বাচ্চাদের খাতা কলম কিনে দিয়ে যায়। সে একজন সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ। সে আমাদের এলাকার স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার জন্য উৎসাহ দেয়। নলুয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমিত কুমার গুপ্ত জানান, তারা মিয়া অনেকদিন যাবৎ স্কুলে এসে বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দিয়ে যায়। এটা আমাদের সকলের জন্য একটি ম্যাসেজ।
তারা মিয়া যখন বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেন, তখন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তাকে অনেক আগ্রহের সহিত বরণ করে নেয়। যা দেখে সমাজের অনেক মানুষ এখন এই কাজটিকে সাধুবাদ জানায়।
২০১৭ সালে ইষ্ট প্ল্যান্ট ইন্সুরেন্স কোম্পানী তারা মিয়ার এ মহৎ কর্মের প্রতি অনুপ্রেরণার,পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের উৎসাহিত করার জন্য তাকে ১ লক্ষ টাকা প্রদান করেন। তারা মিয়া এ অর্থ নিজে ব্যয় না করে এলাবাসীকে নিয়ে গরীব, প্রতিবন্ধী, অসহায় ও দুস্থ্যদের মাঝে বিতরণ করে দিয়েছেন। নলুয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তারা মিয়াকে ফুলের মালা দিয়ে বরন করেছে। এ স্কুলের শিক্ষার্থী রোজিনা আক্তার জানায়, তারা ভাই গরীব হয়েও আমাদের যা কিছু দেন আমরা তা যতœ করে রাখি। উনি আমাদের ভালভাবে লেখা পড়া করার উপদেশ দেন।
তারা মিয়া জানায়, আমার দেওয়া জিনিসগুলো তেমন দামী না থাকলেও এগুলো পেয়ে বাচ্চারা খুব আনন্দ পায়। লেখা পড়ার জিনিস ছাড়াও ছেলেরা আবদার করলে মাঝে মাঝে স্কুলে খেলার জন্য বলও কিনে দেই। বেশীর ভাগ সময়ই নিজের রিক্সা চালিয়ে দিয়ে আসি। কিন্তু এমন অনেক স্কুল আছে যেখানে যেতে রিক্সার রাস্তা থাকেনা। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। দূরের অনেক স্কুল থাকে যেখানে যেতে সময় লাগে আবার সারা দিন রোজগারও বন্ধ থাকে। রিক্সটা আমার নিজের, তাই মহাজনের চিন্তা করতে হয়না। তিনি আরো জানান, আমার ছেলেকে পড়াশুনা করাচ্ছি যাতে করে সে মানুষের মত মানুষ হতে পারে। আমার মত কাজ করতে পারে। তিনি শিশুদের জন্য একটি ব্যাংক হিসাব খুলেছেন যাতে প্রতিমাসে ১ হাজার টাকা করে জমা রাখেন। তা দিয়ে তিনি আরো ভাল কিছু করার উদ্যোগ নেবেন।
সামান্য দিন মুজুর তারা মিয়ার এই মহৎ উদ্যোগ দেখে সমাজের বৃত্তবানরা এগিয়ে এসে শিক্ষার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা এই মানুষটির।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।