অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি কলমাকান্দার চন্দ্রডিঙ্গা

আশুতোষ সাহা: প্রকৃতির অপরূপ শোভা মানব মনকে বিমোহিত করে চিরকাল। আর বিমোহিত মন নিয়েই মানুষ পৃথিবীর আনাচে কানাচে খোঁজে প্রকৃতির অপরূপ রূপ লাবণ্যকে। এ প্রেক্ষিতেই অন্ত:প্রকৃতির টানে,বাহ্য প্রকৃতির অনুপম,লোভনীয় রূপ-মাধুর্যকে দর্শনার্থে চলতি মাসের পাঁচ ডিসেম্বর, বিকেল তিনটায়,দিনের কর্ম সমাপনান্তে বেরিয়ে পড়লাম আমার এ জননী জম্মভূমির অদেখা একটি জিনিসের রূপ দর্শনে। দু’টো মোটর বাইকে চড়লাম আমরা চারজন একই কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী সুমন স্যার,আব্দুল মালেক স্যার,øেহবর লিটন দাস। দর্শনীয় জিনিসটি ছিল অনতি দূরেই। সেটি কলমাকান্দা উপজেলার চন্দ্রডিঙ্গা। এর একটি প্রচলিত ঐতিহাসিক জনশ্রুতি রয়েছে। তা এখানের আলোচ্য বিষয়। তো আমরা বিশ-ত্রিশ মিনিটের মধ্যে পাঁচগাঁও নামক বাজারে এসে ভুরি ভোজনের নিমির্ত্তে কিছু আহার্য ক্রয় করে, মেঘালয় সীমান্ত সংলগ্ন হাতিবেড় গ্রামে পৌঁছে যাই। তখন অপরাহ্ন গোধুলীরও হাতছানি। নীলিমার অঙ্গের জড়ানো আভাও আঁধারের কোলে গমনোদ্যত।
সীমান্ত পাদদেশে নীরব, নিভৃত পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সমতলে বসে ধনে পাতা, সরষের তৈল সংযোগে মুড়ি চানাচুর খাবারের আয়োজন হলো। সবাই চক্রাকারে বসে যাই। আকস্মিক সেখানে আগমন ঘটে আমাদের মত দর্শনার্থী হিসেবে সদর মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েক জন শিক্ষিকার। তাঁরা আমাদের একান্ত আপন। তাই মুড়ি চানাচুর ভোজনের সহযোগী সবাই মিলে আনন্দে তা খাওয়া হলো। শিক্ষিকা জনাবা নূরজাহান খাতুন, যিনি খুবই মমতাময়ী, তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের দর্শনার্থী দলের যেন নিরাপদ আশ্রিতা। শিক্ষিকা ঝুমা তালুকদার, পারভীন আক্তার, রীণা আপু, রুমা তালুকদার আমাদের দলসঙ্গিনী।
আমরা এগিয়ে চললাম পাহাড় অভিমুখে। পাহাড়ের বুক চিরে সুউচ্চ অবস্থান থেকে সরু নালা বেয়ে স্বচ্ছ সলিল ধারা বয়ে চল্ছে সমতল পানে। অবিরাম বয়ে চলা, এ ধারার যেন বিরাম নেই। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে তার যেন অনন্তের পানে এ চলা। এমন নীরব পরিবেশ, প্রকৃতির কমনীয় লীলা ভূমিতে দাঁড়িয়ে কার না মনে হয় কিছু অ¤¬ান স্মৃতি সংরক্ষণ করতে? একে একে সবাই ছবি তোলা ও সেলফিতে মেতে গেল। আঁধার ঘনিয়ে আসার পালা। নির্জন, নিথর পরিবেশ। দল সঙ্গিনী সহকর্মী শিক্ষিকাগণকে আপন আলয়ে ফেরার পথে এগিয়ে দিলাম। আর আমরা অভিপ্রায়ের অংশ বিশেষ চন্দ্রডিঙ্গা দেখার পথে চারজন পুরুষ সঙ্গী পা বাড়ালাম। অতি সন্নিকটেই ছিল এ ডিঙ্গা। কথিত আছে, চাঁদ সওদাগর নামে এক ব্যক্তি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বজরা সাজিয়ে কালীদহ সাগরের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। যা ন্যূনতম হলেও কয়েক হাজার বছর আগের কথা আনুমানিক। আকস্মিক দুর্যোগে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যিক বজরা এখানে এসে নাকি ডুবে যায়। আমরা যে স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সহস্র-যোজন ওজন সম্পন্ন বিশাল পাথরের সুউচ্চ পাহাড়। যেন একটি ডিঙ্গা আকৃতি বিশিষ্ট্য। লতা-গুল্ম আচ্ছাদিত বিশাল এর অবস্থান। দৃশ্যটি মন কাড়ে, প্রাণও কাড়ে। এর ঠিক নি¤œ ভাগে ছত্র ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি কাঁঠালী বট বৃক্ষ। এ বৃক্ষটি যেন কালের সাক্ষী হয়ে ডুবন্ত ডিঙ্গাটির পাশে দন্ডায়মান। সবচেয়ে দীর্ঘায়ু সম্পন্ন এ বৃক্ষ চাঁদ সওদাগর ও তার নিমজ্জিত ডিঙ্গাটিকে যেন ঐতিহাসিক সত্যতা দানের চেষ্টা করছে। আঞ্চলিক লোক মুখেও এ কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।পদ্ম পুরাণ নামক গ্রন্থেও এ ধরণের একটি কাহিনীর কথা উলে¬খ রয়েছে। যা হোক, এ স্থানটির পাদদেশ ঘেঁষে বয়ে চলা একটি নালায় স্বল্প জল ধারা। আশপাশের কৃষকদের জমিচাষের সহায়ক এ নালা। বর্তমান মাসটি হেমন্তের, তাই মাঠ বিস্তৃত পাকা সোনালী ধানের চোখ জুড়ালো দৃশ্য দেখতে দেখতে কিছুটা প্রস্তুত হয়ে যাই মানসিক ভাবে। আর ভাবি এতো মনোরম, অপার সৌন্দর্যের এ লীলা ভূমি সৃষ্টির পেছনে কোন এক স্রষ্টার কথা। স্রষ্টা বিনে কোনো সৃষ্টি কার্য সম্পন্ন হয় না। আমাদের মাতৃভূমির অপরূপ শোভা দানের পেছনে কোন এক অলক্ষ্য নিপুণ কারিগর নিয়োজিত রয়েছেন, অবশ্যই। না হলে এমন রূপ মাধুরী,এমন অনুপম, অপার সৌন্দর্যের, এতো শ্যামল সবুজে, একে বেঁকে চলা পলি বিধৌত নদী-নালা, সবুজে আচ্ছাদিত খানে খানে নাতিউঁচ্চ পাহাড়, নদী বক্ষে পালা তোলা নৌকায় মাঝি মাল¬ার ভাটিয়ালি গান, সরষের ক্ষেতে চোখ ধাঁধালো হলুদ রঙের শোভা কার না মন কারে? বৃক্ষ ডালে পাখির কূজন কত না আনন্দের খোরাক জোগায় বাঙালির মননে। বঙ্গের এরূপ রূপমাধুরী,অনুপম সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করেই আমার লিখা একটি সংগীতের কলিগুলো এ রকম, এই বাংলা আমার মা আমি তার সন্তান/ এই মায়ের পদে সঁপে দিলাম আমার মন প্রাণ/ শ্যামল সবুজ বক্ষ মায়ের বৃক্ষ ডালে পাখির গান/ মেঠো পথে লাঙল কাঁধে চলে যায় রে ভাই কৃষাণ।
বড় আনন্দের বিষয়, এ কৃষাণের দেশেই জন্মেছে কত কবি, সাহিত্যিক, কন্ঠ শিল্পী, আউল-বাউল, রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক আরো কত হস্ত শিল্পী। যাদের ত্যাগ তিতিক্ষায় দেশ আজ বিশ্ব দরবারে সমাসীন। রূপের রাণী প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ বঙ্গে জন্মেছি বলে আমাদের গর্বেরও যেন শেষ নেই। গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, আউল-বাউলের কন্ঠ নি:সৃত সুমধুর সুর, কোকিল-দোয়েলের সুমধুর গান, লাল সবুজের এই সোনার বাংলা এগিয়ে যাক সম্মুখ পানে। বিশ্ব স্রষ্টার কাছে এ প্রার্থনা। তাঁর সৃষ্টি থেকেই আমরা পুষ্ট ও ধন্য।এ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে যেন আমাদের মনের প্রশস্ততা বৃদ্ধি পায়, মন যেন পূর্ণ হয় এ সব মধুময় ও সুখকর বিষয়ের ভাবনায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে ৭টা-সাড়ে ৭টায় আমরা প্রত্যাগমনের ঠিকানায় ফিরে এলাম। মন পূর্ণ রইলো ভ্রমণান্দে। তবে কিছুটা অপূর্ণতা যে ছিল না তা নয়,আর তা হলো কয়েক জন অতি আপনার থেকে আপনজন এ ভ্রমণে আমাদের সঙ্গে না থাকায়। আমার এক মাত্র কন্যা শ্যামা আমার সঙ্গে না থাকায়, তা উলেখও করেছিলেন শ্রদ্ধেয়া নূরজাহান আপা।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।