
জিয়াউর রহমান: কর্মরত চিকিৎসকদের উদাসীনতা, জনবল সংকট, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি না থাকাসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে সেবা বঞ্চিত হচ্ছে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বাসিন্দারা। চালক থাকলেও হাসপাতালের একমাত্র অ্যাম্বুলেন্সটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে গ্যারেজে পরে আছে। বিকল হয়ে আছে এক্স-রে মেশিনটিও। জনবলের অভাবে বন্ধ রয়েছে প্যাথলজি বিভাগ। প্রয়োজনীয় ভবন ও সরঞ্জামাদি থাকার পরও কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার কারণে এক যুগেও চালু হয়নি সিজারিয়ান কার্যক্রম।
এছাড়া হাসপাতালে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জিনাত সাবাহ্। তিনি গত ২৬ সেপ্টেম্বর এ হাসপাতালে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকে তিনি হাসপাতালে সপ্তাহে দু-একদিনও সময় দেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিতে ঢাকায় চলে যান। শুধু তাই নয়, ঢাকায় অবস্থান করতে তিনি মেডিকেল অফিসারদের প্রশিক্ষণেও নিজে চলে যান। প্রতিমাসে বিভিন্ন উপস্বাস্থ কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শনের কথা থাকলেও তিনি অদ্যাবধি কোথাও পরিদর্শনে যাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। মেডিকেল অফিসার পদে ডা. দেবপ্রাণ রায় ও ডা. রজত কান্তি সরকার গত ৩০ মার্চ যোগদান করেন। তবে অন্যান্য চিকিৎসকরা হাসপাতালে সময় দেন না। অনেক চিকিৎসকই হাসপাতালে না গিয়েও কাগজে-কলমে হাজিরা দেখিয়ে নিয়মিত বেতন ভাতা উত্তোলন করছেন ঠিকই। এ অবস্থায় উপসহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ও নার্সরাই রোগীদের একমাত্র ভরসা। চিকিৎসকরা হাসপাতালে সময় না দেওয়ায় হাসপাতাল বিমুখ হয়ে পরেছেন রোগীরা। একেবারে হতদরিদ্র পরিবারের রোগী ছাড়া মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির রোগীরা এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান না। যে কজন জরুরি প্রয়োজনে যান তাদেরকেও আবার রেফার্ড করা হয় অন্য হাসপাতালে। তাছাড়া হাসপাতালে প্রবেশপথে জরুরি বিভাগের সামনে দীর্ঘদিন যাবত ঝড়ে উপড়ে পরে আছে একটি গাছ। এ গাছটির নিচ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে রোগীরা। যে কোনো সময় গাছটির পড়ে গিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশংকা রয়েছে। তবুও গাছ সড়ানোর বিষয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে ৩০ শয্যার এ হাসপাতালটিকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ২০০৬ সালে সিজারিয়ান কার্যক্রম চালু করার জন্য নির্মাণ করা তিন তলা একটি ভবন এবং বহু মূল্যবান যন্ত্রপাতি ওই ভবনের বিভিন্ন কক্ষে স্থাপন করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি সিজারিয়ান কার্যক্রম চালু না হওয়ায় মূল্যবান এসব যন্ত্রপাতি অযতœ ও অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালটিতে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (ডেমাটোলজি), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনী), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারী), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (এনেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (শিশু), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অর্থো), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (চোখ), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (নাক, কান, গলা), ২ জন সহকারি সার্জন (মেডিকেল অফিসার), মেডিকেল অফিসার (ইর্মাজেন্সি), মেডিকেল অফিসার (প্যাথলজিস্ট) ও মেডিকেল অফিসার (ইউনানী) পদে চিকিৎসক নেই। তবে একজন ডেন্টাল সার্জন থাকলেও তিনি মাঝে-মধ্যে হাসপাতালে আসেন।
এদিকে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবস্থা আরও করুণ। কোনোটিতেই মেডিকেল অফিসার নেই। কয়েকটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে উপসহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার থাকলেও তারা নিয়মিত সময় দেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে উপজেলার আশুজিয়া, দলপা ও নওপাড়া ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এতে ওইসব ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধেও। উপজেলার ৩৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও ঔষধ পাওয়ার কথা। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি ক্লিনিক ব্যতীত অন্য ক্লিনিকগুলোতে গিয়ে নিয়মিত সেবা পাচ্ছেনা এলাকার মানুষ। কাগজে-কলমে বিতরণ দেখিয়ে ওইসব ক্লিনিকের বরাদ্দকৃত ঔষধ গোপনে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, ‘কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কেবল মাত্র নামেই সরকারি হাসপাতাল। হাসপাতালে গেলে ডাক্তার পাওয়া যায় না। ঔষধ পাওয়া যায় না। গুরুতর রোগী না হলেও অন্য হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। এ রকম হলে আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক কর্মকর্তা জানান, ‘নতুন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত। অনেক চিকিৎসকই হাসপাতালে আসেন না। এ অবস্থায় যে কজন আছেন তারাও দায়সারা ভাবে কাজ করছেন’।
উপজেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির এমপি প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম ফকির বাচ্চু জানান, ‘আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু ডাক্তার না থাকলে কি আর করব। নতুন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যোগদানের পর থেকেই হাসপাতালে থাকেন না। এতে স্বাস্থ্যসেবা একেবারে রসাতলে গেছে’।
এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জিনাত সাবাহ্র সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে সাংবাদিকদের জানান, আমি ঢাকায় প্রশিক্ষণে আছি। আমাকে ফোন দেন কেনো? আমাকে মোবাইল করে বিব্রত করবেন না।