বিজয়-৭১— হায়দার জাহান চৌধুরী

বছর ঘুরে আবার এলা বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। উত্তাল অগ্নিঝরা ৭১ এর ২৫ শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ২৯০ দিনের রক্তক্ষয়ী সশ¯্রযুদ্ধের মাধ্যমে নতুন জাতী হিসেবে বাঙ্গালী জাতির আত্ম প্রকাশ। স্বশস্ত্র স্বাধীনতার ঐতিহাসিক জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্ন পূরণের এই মাস ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙ্গালী জাতীর সর্বশ্রেষ্ট অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের অবিশ্বরনীয় গৌরবময় চুড়ান্ত বিজয় এই মাসেই অর্জিত হয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে পরিচয় লাভ করে।
বাঙ্গালী জাতি অর্জন করে নিজেস্ব একটি ভূ-খন্ড,আর সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্য খচিত নিজেস্ব জাতীয় পতাকা। ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতার রূপ পায় ১৬ই ডিসেম্বরের ১৯৭১ সালে। দুনির্বার আখাংকার বার্তা নিয়ে প্রতিবছরই এই মাসটি ফিরে আসে আমাদের মাঝে। হেমন্তের নবান্ন উৎসব আর কুয়াশার চাদরে ডাকা এমাসটির সাথে জাতীয় জীবনের সম্পর্ক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আবেগের । তাই তো যখনই বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আসে তখন দেশ প্রেমও দ্রোহের ফলগো ধারায় প্লাবিত হয় গোটা দেশ ও বাংলাদেশের হৃদয়। ২৫ই মার্চের কালো রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শোষিত-বঞ্চিত ক্ষুব্দ জনগণ ন্যায় সঙ্গত ও প্রাপ্য অধিকারের প্রশ্নে দ্বীজাতিয়ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি পাকিস্তান নামক উপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে।
নিঃসকুচে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানের বাঙ্গালী জনগোষ্টী অধ্বষিত পূর্ব বাংলার স্বাধিনতাকামী জনগণ বাংলাদেশ নামক একটি মানচিত্র আকঁতে সক্ষম হয়। দূর্নীবিত সাহসিকতার সাথে লড়াই চালিয়ে পরাজিত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে।
ভৌগলিক সীমারেখার সাথে নিজেদের করে পাই একটি লাল সবুজ পতাকা। আর এই পতাকার জন্যই ৪৫ বছর আগে সময়ের সাহসী সন্তান হিসেবে আমরা আমাদের মাতৃ-ভূমিকে দখলদার পাকিস্তানিদের কাছ থেকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠার লক্ষে মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। তাই মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার মুক্তিযুদ্ধারা জাতীর গর্বিত সন্তান। এই ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বিকার করার কোন উপায় নেই। পাকিস্তানি উপনিবেষিক শাসনের যাতাকল থেকে মাতৃভূমি বাংলাদেশ কে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠান লক্ষে যারা সেদিন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তারাই মুক্তিকামী জনতার লড়াকো বাহিনী, আর এই লড়াকো বাহিনী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল সবার কাছে প্রিয় ও আস্তাভাজন। দেশ প্রেমে উদ্ভোদ্ধ হয়ে এক বুক ভালবাসা নিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সূদির্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে হাজার বছরের রাজনৈকিতক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বপ্ন স্বাদ পূরণ করেছে বলেই এই মাসটি মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগের সাথে জড়িত। ডিসেম্বর এলেই মুক্তিযোদ্ধারা আবেগ তাড়িত হয়ে অতীত দিনের স্মৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। বহু তরতাজা প্রাণ বিসর্জন,আর মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে এই অর্জন বেদনা বিধুর এক শোক গাথার সব কাহিনী। এই ডিসেম্বর মাসেই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হানাদার বাহিনী ও তার এদেশীয় দোষর আলবদর ,আল-শামছ,রাজাকার বাহিনী সহযোগীতায় দেশের মেধা শ্রেষ্ট সন্তান, শিল্পূী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবিদের নিঃসঙ্গস হত্যাকান্ডে মেতে উঠে।
সমগ্র জাতীকে মেধা শূণ্য করার এ ধরণের গৃণ্য হত্যাকান্ডের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে ডিসেম্বর মাস মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্য ক্রমশই ভয় ভীতি ও হতাশা দেখা দিতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র গেরিলা তৎপরতায় ও পরিকল্পিত অপারেশনের ফলে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র,যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ্য স্থাপনায় হামলার ফলে এসব বন্ধ ও ভেঙ্গে পড়ায় হানাদার বাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়ে। হানাদার বাহিনী দিনের বেলা ছাড়া খুব বেশী একটা বের হতে পারত না। রাতের বেলায় সবত্রই ছড়িয়ে ছিঠিয়ে থাকা অকুতভয় মুক্তিসেনাদের দখলে থাকত গ্রাম বাংলার জনপদ। গ্রামাঞ্চলের মানুষ অত্যান্ত আগ্রহ ভরে মুক্তিযোদ্ধাদের কে গর্বের সহিত সাহায্য সহযোগীতা করত। হানাদার বাহিনী সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিন্দু মাত্র সাহায্যও পায়নি। বরং সাধারণ মানুষ দেখে মুক্তি মনে করে আতংকিত হয়ে পড়ত। সাধারণ মানুষের প্রবল গ্রীণা ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী দালাল, আলবদর,রাজাকারদের প্রতি। সুযোগ পেলে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গোপনে খবর পাঠিয়ে হানাদারদের কে ধরিয়ে দিত অথবা খতম করতে সাহায্য করত। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ আর ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্র বাহিনীর জল স্থল ও আকাশ পথে যৌথ সাঁড়াষি আক্রমনের মুখে বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পরাজয়ের খবর চারদিক থেকে ভেসে আসতে থাকে। সেই সাথে হানাদার বাহিনী দেশের সর্বত্রই ঘেরাও হয়ে পড়ে । ঐ বছরের ১৬ই ডিসেম্বর ৭১ ঢাকার ঐতিহাসিক রেসর্কোস ময়দানে (ঐতিহাসিক সহরাওয়াদী উদ্যানে) পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কমান্ডার জেলারের নিয়াজী সহ ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সেনা মিত্র বাহিনীর কাছে আত্ম-সর্মপণ করতে বাধ্য হয়। তারও এক সপ্তাহ পড়ে ৯ ডিসেম্বর নেত্রকোনা মুক্ত হয় । ৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর ভোর রাত্র থেকেই নেত্রকোনা শহরকে হানাদার মুক্ত করতে নেত্রকোনার মুক্তিযোদ্ধারা চতুরমুখি হামলা চালায়। হামরার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে হানাদার বাহিনী ও তার দোরস রাজাকার দালাল সহ ময়মনসিংহ শহরের পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তারপাড়া ব্রীজ সংলগ্ন কৃষি ফার্মের নিকটে ময়মনসিংহ নেত্রকনোর রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রীব্র আক্রমনের মুখে পড়ে । এসময় হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সম্মুখ যুদ্ধে আমাদের তিন মুক্তিযোদ্ধা আবু খাঁ,আব্দুস সাত্তার ও আব্দুর রশিদ শহীদ হন।
বর্তমান বাংলাদেশ এক অশুভ ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর অপতৎপড়তাসহ আমাদের এই মানচিত্রের উপর দেশী-বিদেশী হায়নাদের শেনসৃষ্টি স্বাধীনতা সার্বোভোসত্ব ও গণতন্ত্র আজ হুমকির মুখে। তাই আজ সময় এসেছে মুক্তিযোদ্ধের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠা জাতী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবি শক্তির সমন্বয়ে দেশ প্রেমিক জনগণের দূর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে স্বাধীনতা সার্বভোত্ব ও অক্ষন্ডতা রক্ষায় অগ্নি শপতে বলিয়ান হয়ে মুক্তিযোদ্ধের চেতনার প্রবল বানে এই অশুভ জঙ্গি তৎপরতা ও দেশী বিদেশীদের দুরবিসন্ধিমূলক স্বরযন্ত্র ভেসে যেতে বাধ্য হবে। লেখক, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক ; অনুলিখন হানিফ উল্লাহ আকাশ

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।