পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত করা হোক

বিশেষ প্রতিনিধি: বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধকারী শক্তিটি ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা। সেদিন তাঁরা নিজেদের নির্ঘাত মৃত্যুর কথা জেনেও থ্রি নট থ্রি দিয়ে পাকিস্তানি ট্যাংক, কামান, গোলাবারুদের বিরুদ্ধে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল।
রাত প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩৭টি ট্রাক আর্মি ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরের দিকে বের হয়। পুলিশের ওয়ারলেসের মাধ্যমে বিষয়টি জানান ফার্মগেটে টহলরত পুলিশের একটি টিম। সেইসব ট্রাকের একটি অংশ আঘাতহানে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে।
আর সেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত ১১টা ৫৫ অথবা ৫৭ মিনিটে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের ওয়ার্লেস বেইজ স্টেশনের অপারেটর মো. শাহজাহান মিয়া অসীম সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পাক আর্মি রাজারবাগকে আক্রমণ কারার সাথে সাথে নিজ উদ্যোগে তৎকালিন দেশের উনিশটি জেলা ও বত্রিশটি সাব-ডিভিশনের পুলিশ স্টেশনে জানিয়ে দেন যে, ÒBase for all station of east Pakistan police, very very important massage for you, keep note, keep listening, watch. ÔWe are already under attacked by Pak army, try to save yourself, over and outÕ.Ó

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সংঘটিত হবার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গ্রেফতারের পূর্বে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর ১২ টা ৩০/৩৫ মিনিটে তিনি ইপিআরের একটি ছোট ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছিল (This may be my last massage, from to-day Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you fight be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expedited form the soil of Bangladesh and final victory is achieved.) এটির বাংলা অনুবাদ ছিল ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’


কিন্তু অপারেশন সার্চলাইট শুরুহলো রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইপিআর সদর দপ্তরে। তখন সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা সরকারি বাহিনী পুলিশের ওপর সর্বপ্রথম আঘাতটি আনা হয়। সেদিন দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য শহিদ হন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে। আর পুলিশই সর্বপ্রথম অস্ত্র হাতে তুলে নেয় বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্যে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধকারী হিসেবে ২০১১ সালে বাংলাদেশ পুলিশকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয়। সেই পুরস্কারের সময় শাহজাহানের এই অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়।
শাহজানের এই বার্তাটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যে প্রথম প্রতিরোধী বার্তা। দেশের ১৯টি জেলায় পুলিশ স্টেশনের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশ ইতিমধ্যে পাকিস্তানি আর্মিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আপনারা অস্ত্র হাতে তুলে নেন। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এগিয়ে আসুন। এটিই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যে প্রথম প্রতিরোধী বার্তা। এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম বার্তাটি প্রেরণ করেন তখনকার পুলিশের সদস্য মো. শাহজাহান। তিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিরও বিশেষ বিশেষ অংশ ওয়ার্লেসের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিতে থাকেন।
এই মহান মুক্তিযোদ্ধার সাথে তাঁর বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার বাট্টা গ্রামের বাড়িতে সাক্ষাৎ হয়। তাঁর জীবনে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথমপর্ব থেকে বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধের নানা কথা তুলে ধরেন। স্মৃতিচারণে চোখের পানি ফেললেন। রাজারবাগ পুলিশ ওয়ার্লেস বেইজ স্টেশনে সেই ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের কাহিনী।
সেই রাতে পুলিশের অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে মুক্তিপাগল পুলিশ সদস্যরা মরণপণ লড়াইয়ে নামে পাকিস্তানি আর্মিদের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানিদের অধীনে চাকুরঅ ছেড়ে, নিজের ভবিষ্যত ভাবনা ছেড়ে, পরনের উর্দ্দির কথা ভুলে গিয়ে সেদিন পাকিস্তানি আর্মিদের সাথে রাত আড়াইটা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। বাংলাদেশিদের একটি গুলির জবাবে পাক হানাদাররা নিক্ষেপ করেছে হাজার হাজার গুলি। পুলিশের এই প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি মেসেজটি পাঠিয়েই চলে আসেন যুদ্ধক্ষেত্রে। হাতে তুলে নেন অস্ত্র। পুলিশের সাথে সেনাবাহিনীর এই যুদ্ধে এক সময় হায়েনারা আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিন রাতে দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য দেশমাতৃকার জন্যে পাকিস্তানিদের হাতে শহিদ হন। ৭/৮টি ট্রাকে করে সেই সব শহিদদের লাশ নিয়ে উধাও করে ফেলে পাকিরা।
ভোরে যুদ্ধ শেষে পানির ট্যাংকির নিচ থেকে মো. শাহজাহান মিয়াসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে পাক আমির্রা । ২৬ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত বন্দি থাকাবস্থায় নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ২৯ মার্চ বিকালে পুলিশ মিল ব্যারাক থেকে পালিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করেন। শুন্য পকেট আরেক বন্ধুকে সাথে নিয়ে হেটে হেটে বাড়ির পথে পাড়ি দেন। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নির্যাতিত শরীর নিয়ে বাড়ি পৌঁছেন। সেখান থেকে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে পাড়ি দেন ভারতে। সেখানে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ক্যাম্পে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের ১১ নং সেক্টরে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। চান্দুয়ায়, বিজয়পুর, ধর্মপাশাসহ বড় বড় পাঁচটি যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ৭ ডিসেম্বর বিজয়পুর যুদ্ধজয়ে ফেরার পথে পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের স্পিনটারে বিদ্ধ হয়ে বাম পায়ের পাতা গুলি বিদ্ধ হয় তাঁর। প্রথম প্রতিরোধকারী মেসেজ প্রেরক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিদান এবং তাদের মধ্যে আত্মত্যাগের প্রেরণা সৃষ্টির লক্ষে বীরত্বসূচক খেতাব প্রদানের জন্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী মে মাসের প্রথমদিকে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদে উপস্থাপন করেন। ১৬ মে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বীরত্বসূচক খেতাবের প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়। এ পরিকল্পে চার পর্যাযের খেতাব প্রদানের বিধান ছিল: (ক) সর্বোচ্চ পদ, (খ) উচ্চ পদ, (গ) প্রশংসনীয় পদ, (ঘ) বীরত্বসূচক প্রশংসাপত্র।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সভায় বীরত্বসূচক খেতাবের নতুন নামকরণ হয়: সর্বোচ্চ পদমর্যাদার খেতাব হচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠ (৭ জন), উচ্চ পদমর্যাদার খেতাব হচ্ছে বীর উত্তম (৬৮ জন), প্রশংসনীয় পদমর্যাদার খেতাব বীর বিক্রম (১৭৫ জন) এবং বীরত্বসূচক প্রশংসাপত্রের খেতাব দেয়া হয় বীর প্রতীক (৪২৬ জন) নামে।
১৯৭২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বীরত্বসূচক খেতাবের জন্য নির্বাচন করা হয়। ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ পূর্বের ৪৩ জনসহ মোট ৫৪৬ জন মুক্তিযোদ্ধা খেতাবের জন্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বা পরবর্তী সময়কে বিভিন্ন ইউনিট, সেক্টর, ব্রিগেড থেকে পাওয়া খেতাবের জন্য সুপারিশসমূহ এয়ার ভাইস মার্শাল এ. কে খন্দকারের নেতৃত্বে একটি কমিটি দ্বারা নিরীক্ষা করা হয়। এরপর ১৯৭৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খেতাব তালিকায় স্বাক্ষর করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জন, বীর উত্তম ৬৯ জন, বীর প্রতীক ৪২৬ ও বীর বিক্রম ১৭৫ জনের মধ্যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে নৌবাহিনী ১, বিমান ১, রাইফেলস ২ ও সেনাবাহিনী ৩ জন। বীর উত্তম ৬৮ জনের মধ্যে একমাত্র কাদের সিদ্দিকী ছাড়া বাকিরা নৌ, বিমান, সেনাবাহিনীর সদস্য। বীর প্রতীকের ৪২৬ জনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ১১৯ (সাধারণ মানুষ) মুজাহিদ ৯ জনসহ ১২৮ জন ব্যতীত বাকিরা সবাই বিমান, সেনা ও নৌবাহিনীর। বীর বিক্রমের ১৭৫ জনের নৌ ১০, গণবাহিনীর ৩৪, বিমানের ১ ও সেনার ১৩০ জনসহ ৪টি খেতাবে মোট মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জন, বীর উত্তম ৬৯ জন, বীর প্রতীক ৪২৬ ও বীর বিক্রম ১৭৫ জনের মধ্যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে নৌবাহিনী ১, বিমান ১, রাইফেলস ২ ও সেনাবাহিনী ৩ জন। বীর উত্তম ৬৯ জনের মধ্যে একমাত্র কাদের সিদ্দিকী ছাড়া বাকিরা নৌ, বিমান, সেনাবাহিনীর সদস্য। বীর প্রতীকের ৪২৬ জনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ১১৯ (সাধারণ মানুষ) মুজাহিদ ৯ জনসহ ১২৮ জন ব্যতীত বাকিরা সবাই বিমান, সেনা ও নৌবাহিনীর। বীর বিক্রমের ১৭৫ জনের নৌ ১০, গণবাহিনীর ৩৪, বিমানের ১ ও সেনার ১৩০ জনসহ ৪টি খেতাব প্রদান করা হয়। মোট ৬৭৭ জনের মধ্যে ১৯৪ জন ব্যতীত বাকি সকলেই সেনা, নৌ, বিমান ও ইপিআরের সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদানের জন্যে স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১১ প্রদান করা হয়েছে। সেসময় যেসব পুলিশদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এলো তাঁদের মধ্যে মোঃ শাহজাহান অন্যতম। তিনিই প্রথম মেসেজ প্রেরক। সম্মুখযোদ্ধা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তাই তাঁর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে মোঃ শাহজাহান মিয়াকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হোক। মূল্যায়নের খতিয়ানে মুক্তিযোদ্ধো বিষয়ক মন্ত্রীসহ প্রধানমন্ত্রী দৃষ্টিতে আসুক এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম,জীবন সায়াহ্নে এসে এটাই চান বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।