স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাওর পাড়ের মানুষ

সৌমিন খেলন: শারীরিক নানাবিধ সমস্যা ও দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের খালিয়াজুরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন রোগীরা আসেন। কিন্তু নার্স আর ওয়ার্ডবয় ছাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটিতে চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যায় না। চিকিৎসকরা চিকিৎসা কেন্দ্রে আসেন কালেভদ্রে। দিনভর রোগীরা দূর দূরান্ত থেকে এসে চিকিৎসক না পেয়ে ফিরে যান বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
বাংলার নেত্রের কাছে এমন অভিযোগের কথা জানালেন রোগে কাতর দরিদ্র অসহায় হাওরবাসী কয়েকজন মানুষ।
গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা ও কোমরের ব্যথায় আক্রান্ত কৃষ্টপুর গ্রামের দিগেন্দ্র চন্দ্র দাস (৫৪)। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে তিনি কোনো ডাক্তারের দেখা পাননি।
বাংলার নেত্রকে তিনি জানান, ডাক্তার আসবেন এমন আশায় প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে শেষে ডাক্তার ও চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হয়।
তিনি আরো জানান, তবে চিকিৎসা ছাড়া যাদের ফেরার সুযোগ থাকে না তারা চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী উপজেলা অথবা জেলা শহরে যেতে বাধ্য হন।
শারীরিক দুর্বলতার সমস্যা নিয়ে বল্লভপুর গ্রাম থেকে এসেছেন রেখা রাণী সরকার (৪৮)। তিনি প্রায় প্রতিদিনই ডাক্তারের সক্ষাতের আশায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরেও তিনি কোনো ডাক্তারের দেখা পাননি!
তাতিয়া নগর থেকে এসেছেন চন্দ্র বালা (৫০) ও কিশোরী মোসাম্মৎ তানজিনা আক্তার (১৪)। স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় খালিয়াজুরী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছেন তারা। পরে ডাক্তারের অপেক্ষায় সারা দিন পার হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দেখা না পেয়ে বিকেলে তারা বাড়ি ফিরে যান।
পথিমধ্যে চন্দ্র বালা বাংলার নেত্রকে জানান, সরকার টাকা খরচ করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ওষুধ, ডাক্তার ও নার্স সব দিয়েছে। কিন্তু যারা দায়িত্বে আছেন তাদের কর্তব্যে ফাঁকিবাজি এবং অসততার কারণে সরকারের সব উদ্দেশ্য ভে যাচ্ছে!
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে পর্যবে রেখে হাওরাঞ্চলের অসহায় সাধারণ মানুষের এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামের রোগীরা এখানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ডাক্তারের দেখা পাননি। অগত্যা হতাশ হয়ে তাদের কেউ কেউ নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালমুখি হয়েছেন। যারা হতদরিদ্র তাদের অনেকেই রোগ আর চরম হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেগাজিন নকরেক,পানামী ঢালি ও মালেসা রেমা নামের তিনজন নার্সের দেখা পাওয়া যায় সেদিন। তাদের মধ্যে কেউই জানাতে পারলেন না স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার কোথায় থাকেন। তবে ডাক্তারের অনুপস্থিতে তারা নিজেরাই রোগী দেখার কাজটুকু করে থাকেন বলে বাংলারনেত্রকে জানালেন।
মেগাজিন নকরেক জানান, তিনি একাই মেডিসিন ওয়ার্ড ও জরুরি বিভাগ দেখেন। এতে করে তার অমানবিক পরিশ্রম হয়। কাগজে কলমে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনজন ডাক্তার রয়েছেন। তারা হলেন টিএইচএ সাইফুল ইসলাম, মেডিকেল অফিসার নুরুল হুদা খান ও মাজরাতুল ইসলাম শিকমা।
খালিয়াজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছানোয়ারুজ্জামান জোসেফ বাংলারনেত্রকে জানান, উপজেলায় নামমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে। যেখানে নেই কোনো স্বাস্থ্যসেবা। এখানকার গরীব অসহায় মানুষগুলো অসুস্থ হলে চরম বেকায়দা পড়েন। চেয়ারম্যান জোসেফ তার বৃহস্পতিবার দুপুরের এক অভিজ্ঞতার কথা বাংলারনেত্রকে জানান।
তিনি বলেন, ওইদিন দুপুরে তিনিসহ খালিয়াজুরী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহসিন বসেছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তোফায়েল আহমেদ’র কক্ষে। তখন সোহেল মিয়া নামে এক রোগীর বড়ভাই মো. এরশাদ মিয়া ইউএনও’র কাছে ডাক্তার না থাকার অভিযোগ দিতে এলেন। এরশাদ জানান, দুদিন ধরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পেট ব্যথায় আক্রান্ত ভাইকে নিয়ে ডাক্তারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ডাক্তার পাননি তিনি। তবে এ দুদিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্সরা তার ভাইকে সাধ্যমতো নামকাওয়াস্তে চিকিৎসা দিয়েছেন।
পরে ওই রোগীকে দেওয়া পেসক্রিপশনে দেখা যায়, ১৮ বছরের রোগী সোহেলের বয়স লেখা হয়েছে ‘২২০ বৎসর’। আর অভিভাবক হিসাবে সোহেলের পিতার নাম না লিখে লেখা হয়েছে ‘স্বামী’। বিষয়টি চেয়ারম্যান জোসেফ তাৎক্ষণিকভাবে সিভিল সার্জন ডা. তাজুল ইসলামকে অবহিত করেন। এসময় সিভিল সার্জন তিন জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন জানিয়ে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার না থাকার বিষয়ে জেলা প্রসশাসক ড. মো. মুশফিকুর রহমানকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে বাংলার নেত্রকে জানান ইউএনও মো. তোফায়েল আহমেদ।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যাকবলিত ক্ষতিগ্রস্ত হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরীতে গত ১৮ মে এসেছিলেন। তখন তিনি খালিয়াজুরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি পরিদর্শন করেন।
হাওরবাসীদের শতভাগ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে এবং চিকিৎসা নিয়ে কোনো ধরণের গাফিলতি না করতে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ বিন্দুমাত্র আমলে নেননি কর্মরত চিকিৎসকরা। এমন অভিযোগ রয়েছে তাদের।

শর্টলিংকঃ
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।